শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, পৌষ ৭ ১৪৩১

জাপানের পথে পথে (পর্ব-৭) মেট্রোজীবন ও চিত্রশালা

সাইম রানা

প্রকাশিত: ২৩:১৭, ১৩ এপ্রিল ২০২২

আপডেট: ১৫:২৩, ২৭ এপ্রিল ২০২২

জাপানের পথে পথে (পর্ব-৭) মেট্রোজীবন ও চিত্রশালা

জাপানের পথে পথে (পর্ব-৭)

১২ ই জুন ২০০৫ । সকালে সেনসেই আর গাড়ি বের করলেন না। শুরু হল ট্রেন ভ্রমণ। বাসা থেকে ৫/৭ মিনিটের পথ হেঁটে কামিমাছি স্টেশনে পৌঁছুলাম। সেখান থেকে শিবুয়া স্টেশন পর্যন্ত যেতে হবে সেতাগায়া লাইনে উঠে । স্টেশন থেকে তিনি আমার জন্য একটি জেআর (জাপান রেলওয়ে) লাইনের জন্য সুইকা ও অন্যান্য লাইনের জন্য প্রিপেইড কার্ড সংগ্রহ করলেন। এছাড়া কীভাবে সাবওয়ে বা মেট্রোতে উঠানামা করতে হয়, এক লাইন থেকে অন্য লাইন বা ট্রেন কীভাবে বদল করতে হয় তা বোঝালেন । যতদূর মনে পড়ে, টোকিও শহর জুড়ে তখন প্রায় উনিশটা লাইন জুড়ে মাটির উপরে নীচে শত শত টানেলের ভিতর দিয়ে ট্রেনগুলো দাপিয়ে চলেছে। এদেশে শ্রমিকেরা মাটির তলদেশ, পাহাড় খুঁড়ে খুঁড়ে যোগাযোগের এমন এক জাল বিছিয়ে রেখেছে যে, কোনো নবাগত পর্যটকের জন্য রীতিমত একটা বিভীষিকা মনে হবে। তবে সুপরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খলতার কারণে দু’চারদিনেই তা সহজ হয়ে যাবে।

প্রত্যেক ট্রেন ও ট্রেন লাইনের বর্ণ ভিন্ন, যা দেখে মুহূর্তেই যে কেউ জেনে যাবে যে কোনটা কোন লাইন। আমার খুব ভালো লেগেছিল চমৎকার এক পৃষ্ঠার একটি টোকিও সাবওয়ে ম্যাপ হাতে পেয়ে। পুরো শহরটা যেন হাতের মুঠোয়। লাইনগুলোর নাম রুট অনুযায়ী সাজানো, যেমন গিনজা, মারুনউচি, হিবিয়া, তোদাই, চিয়দা, সিনজুকু, ওয়েদো, মিতা, নামবকু ইত্যাদি নামে পরিচিত। তবে বেসরকারি ও সরকারি দুই ধরনের লাইনের মধ্যে সরকারি জেআর লাইন তুলনামূলক মন্থর, মলিন এমনকি পুরনোও। এই দিকটি আমার একটু নজরে এলে সেনসেইকে ব্যপারটি বললাম, তিনি একটু বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিলেন, সরকারি তত্ত্বাবধানের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাইভেট কোম্পানির মতো এতো যত্নশীল ও তৎপর নয়।

ট্রেনে উঠে সবার আগে নজরে এলো বয়স্ক, সন্তানসম্ভবা, শিশু ও প্রতিবন্দিদের জন্য আলাদা বেঞ্চের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে নারী-পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট কোনো আসন নেই। তবে শিশুরা কখনো দাঁড়িয়ে থাকবে না, সে যেখানেই উঠবে, তার সামনের লোকটি আসন ছেড়ে দেবে, এটাই অলিখিত রীতি। অধিকাংশ যাত্রীই কোন না কোন কাজে ব্যস্ত, কেউ গান শুনছে ওয়াকম্যান বা আইপডে, কেউ বই পড়ছে, কেউ কার্টুনের (মাঙ্গা) বই উল্টোচ্ছে (উল্লেখ্য জাপানে মাঙ্গা খুবই জনপ্রিয়, এই ম্যাগাজিনগুলো শুধু শিশুদেরই প্রিয় নয়, বরং বৃদ্ধ-যুবক নির্বিশেষে সকলের প্রিয়। কারণ কার্টুনিস্টরা এই তাদের দৈনন্দিন জীবনের আকর্ষণীয় ঘটনাগুলো সিরিজের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলে); আর অধিকাংশই চোখ মুদে আছে ক্লান্তি-শ্রান্তিতে। তবে ঘুমুলেও প্রত্যেকের কান সজাগ। কারণ ট্রেন স্টেশনে আসার আগেই ঘোষণা দিচ্ছে সামনের স্টেশনের। যে যার গন্তব্যে আসার আগেই জেগে উঠছে, এভাবেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে তারা।

প্রতিটি স্টেশনে যখন ট্রেন এসে থামছিল, একদিকে দরজা খুলে গেলে যাত্রীরা দ্রুত নামা-উঠা করছিল, অপর দিকে দেয়াল জুড়ে নানা ধরনের মুরাল অথবা ভাস্কর্য, ছবি বা চিত্রকলা সারি সারি সাজানো রয়েছে। অজস্র বোধের প্রকাশ ঘটিয়ে রেখেছে শিল্পীরা শত শত স্টেশনে। প্রতিটি স্টেশন যেন একেকটা সুবিশাল আর্ট গ্যালারি। প্রত্যেক যাত্রী যখন প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ায়, তার সামনে সেই শহরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, কিংবা প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মারক বহন করা ক্যানভাস চোখে সামনে এসে পড়ে । যেমন যে শহর কাবুকি থিয়েটারের জন্য বিখ্যাত, সেখানে থিয়েটারের নানা অনুষঙ্গ চিত্রে ধরা পড়বে, যে শহর সুমো কুস্তির জন্য প্রসিদ্ধ, সেখানে সেই ধরনের ক্যানভাস চোখে পড়বে।কোথাও কোথাও আধুনিক চিত্রকলা স্থান পেয়েছে। শুধুমাত্র প্লাটফর্মের সামনেই নয়, স্টেশনে ঢুকতে-বেরুতে চলমান সিঁড়ির দুইপাশে অথবা প্রশস্ত দেয়ালগুলোতে অসাধারণ এক্সপেরিমেন্টাল কাজও চোখে পড়বে। প্রকৃত অর্থে টোকিও মহানগরকে মেট্রো ছাড়া কল্পনা করা যায়না, পুরো জীবন ব্যবস্থাটাই স্টেশনকেন্দ্রিক, ফলে কোম্পানির ছোট বড়ো বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ড দেখেও চোখ ধাঁধিয়ে যেতে পারে। নবাগত বা পর্যটকদের জন্য এই শিল্পনিদর্শনগুলো অবর্ণনীয় কৌতূহলোদ্দীপক। শুধু প্রয়োজন একটু শিল্পমন।

শিবুয়া স্টেশনটি জাপানের সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকায় অবস্থিত। এখানে একমিনিটের ট্রাফিক সিগনালে কয়েক হাজার মানুষ জমে যেতে পারে। মজার ব্যাপার এইযে শিবুয়া নদীর নামে এই স্টেশন তৈরি হলেও নদী দেখা যায়না, কারণ রাস্তার দুপাশে যে বিশাল জায়গা, যেখানে মানুষ কিলবিল করছে, এরই নীচ দিয়েই শিবুয়া নদীর স্রোত বয়ে চলেছে, নদী শাসনের অদ্ভুত চরিত্রকে প্রশ্নের ভিতরে রেখেই যোগাযোগ ব্যবস্থাকে প্রচণ্ড গতিশীল করেছে তারা, ফলে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ যাত্রী আসা যাওয়া করে শুধুমাত্র এই স্টেশনেই।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে সেরকম জনস্রোতের সাথে দাঁড়ালাম। পথচারী পারাপারের সবুজ বাতিটা জ্বলে উঠলো। রাস্তা পার হয়ে একটি মার্কেটের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। মোবাইলের দোকানে ঢুকলাম, ইন্টারনেট ডাটাসহ একটি মোবাইল ও মানিব্যাগ কিনলাম। আমি যদিও একটি প্রিপেইড কিনলাম স্বল্পকালীন অবস্থানের সুবিধা বিবেচনা করে। জাপানে মোবাইল কোম্পানি মূলত সিডিএমএ পোস্টপেইড সিস্টেমে চলে, ফলে কোনও সিম কার্ড নেই। মোবাইল কোম্পানিগুলো দামি দামি সেট খুবই স্বল্প মূল্যে ক্রেতাকে দিয়ে থাকে। ২০০৫ সালে মোবাইল ডাটা আমার কাছে একটি বিস্ময়কর কাণ্ডও মনে হল। কিন্তু কলরেট (সম্ভবত ৬০ ইয়েন বা ৫০ টাকা প্রতি মিনিট ) এতো বেশি ছিল যে, কথা বলাই দুষ্কর মনে হতো। কলরেট আকাশচুম্বী হওয়ায় দেখলাম ট্রেনে রাস্তায় প্রায় সকলেই কথা না বলে টেক্সট মেসেজ ও ম্যাসাঞ্জার ব্যবহারে ব্যস্ত। ও হ্যাঁ তখনো ফেসবুক বা উইচ্যাট, হোয়াটস-আপ কোন কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না।