শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, পৌষ ৭ ১৪৩১

জাপানের পথে পথে – (পর্ব-৪) আইওইন মন্দিরে সৌম্য

সাইম রানা

প্রকাশিত: ২৩:০০, ১৩ এপ্রিল ২০২২

জাপানের পথে পথে – (পর্ব-৪) আইওইন মন্দিরে সৌম্য

জাপানের পথে পথে – (পর্ব-৪)

২০০৫ সালের ১১ই জুন । টোকিও শহরের প্রথম দিনের সকাল। প্রফেসর কিয়োকোর সেতাগায়া কু-এর বাসায় দক্ষিণের জানালা দিয়ে তীর্যক আলো ঘরে ঢুকছে। জানলার পাশেই কাঠের একটি গোল ডাইনিং টেবিল। খুবই সাধারণ ডিজাইন, কিন্তু অভিজাত। প্রফেসর কিয়োকো বাইরে থেকে নাস্তা নিয়ে এলেন। তিনি নিজে থেকেই ধরে নিয়েছেন আমি যেহেতু মুসলমান, ফলে পোর্গ বা শুকরের মাংশ গ্রহণ করি না। কিন্তু যে ব্রেডটি নিয়ে এলেন, তা কাটতে গিয়ে বেরিয়ে এলো ঠিক মাঝ বরাবর লাল জিহবার মতো একটা মাংশের ফালি । এটা দেখে প্রফেসর নিজের জিহবায়ও একটু কামড় দিলেন। তবে আমি সহজভাবে নিলাম, বললাম, শুধু ব্রেড এর অংশটুকু হলেই চলবে, এর সাথে একটু বাটার ও এক কাপ কফি খেলাম।সাথে খনিজ লবনের মতো দেখতে একদলা খয়েরি চিনি যোগ করলাম।


খেতে খেতে কথা হলো আমি কোথায় থাকবো। পাউরুটির ফালি মুখে পুরে, ১১ ইঞ্চির ছোট ল্যপটপে অনলাইনে এ্যাপার্টমেন্ট খুঁজতে শুরু করলেন। কিন্তু এত দ্রুত কোনো বাসা পাওয়া টোকিও শহরে প্রায় অসম্ভব, আবার অনেক ব্যস্ততার কারণে তিনি আগে থেকেও কোনো ব্যবস্থা করতে পারেননি। আমি যে বুনকা-চো স্কলারশিপ নিয়ে এসেছি, কর্ত্তৃপক্ষ টাকা দিয়েই খালাস হবেন, কিন্তু সার্বিক তদারকি নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই।


বাসা থেকে বেরুনোর আগে আমার আগমনের কথা মিনিস্ট্রিকে নিশ্চিত করা হল, এরপর এ্যাপার্টমেন্ট খোঁজার কাজে একটি অফিসে গেলাম। সেখানেও কোনো বাসা মিলল না। অগত্যা একটি মার্কেটে ঢুকলাম। দেখলাম অচেনা অসংখ্য ফল-মুল, নানা বৈচিত্রের জাপানিজ খাবার থরে থরে সাজানো। শুষি ও শাসিমির কথা বইতে পড়েছি। প্রফেসর সরাসরি দেখিয়ে দিয়ে জানতে চাইলেন, আজকের মধ্যাহ্ণভোজে এগুলো চলবে কি না। আমি মৌন অসম্মতি জানালাম, কাঁচা মাছ-মাংশের স্লাইস খেতে হবে এটা ভেবেই আমার ভেতরটা একটু ঘিনঘিন করে উঠলো। ততক্ষণে দুপুর গড়িয়েছে। আমরা বাসায় ফিরে একটু জিরিয়ে নিলাম। বিকেলে আবার ভর্তির কাজে বেরুতে হবে।


প্রফেসর তার ১০ দিন আগের কেনা ওয়াইন-রেড নতুন গাড়িটি বের করলেন। ৩০ মিনিট মতো টোকিওর অলিগলি ঘুরে পৌঁছুলাম আইওইন মন্দিরে। সুবিশাল মহীরুহ বা তরুছায়া বেস্টিত শান্ত-নির্জন বনানীর মাঝে ছোট্ট কাঠের প্রাসাদ। প্রধান ফটকের পাশে একটি রিসিপশন ঘর। সেখানে এক বৃদ্ধা বসে আছেন। তাঁকে জানানো হলো যে আমরা মন্দির প্রধান ওয়াসেই হিরাই সান এর কাছে এসেছি। কিছুক্ষণ পর হিরাই সান এলেন। আমরা কননিচি ওয়া বলে মাথা নুইয়ে সম্বোধন করলাম। তিনিও বাউ করে বললেন আরিগাতো গোজাইমাসতা। তারপর তাঁকে একটি বড়ো প্যাকেট উপহার দিলেন প্রফেসর, যা আসার পথে আমার পক্ষ থেকে কেনা হয়েছিল। আমি বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া কিছু উপহারের সাথে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন প্রযোজিত শান্তি শর্মার সেলেব্রেশন শিরোনামের একটি ক্লাসিক্যাল মিউজিকের এ্যালবাম দিলাম। গাড়ীতে বসেই প্রফেসর বলছিলেন মন্দিরের পুরোহিতগণ দামি মদ পছন্দ করেন, তুমি তা দিতে রাজি? যেই অঞ্চলের যেই ভাউ, মনে মনে এই ভেবে সম্মতি দিয়েছিলাম।


ওয়াসেই হিরাই আমাদেরকে মন্দিরের ভেতরে নিয়ে গেলেন। ছোট বড় অনেকগুলো ঘর ও গলি ঘুরে একটি পাঠদান কক্ষে এসে পৌঁছুলাম।বাইরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, ভেতরে বৌদ্ধমন্ত্র পাঠ চলছে। আমার জন্য কিছু কাগজ-পত্র আগে থেকেই প্রস্তুত করা ছিল, সেগুলোর কিছু ইংরেজি, কিছু জাপানিজ। প্রফেসর বুঝিয়ে দিলেন , সেই মোতাবেক আমি ঘর পুরণ করলাম। এরপর চলমান স্তোত্রপাঠের ক্লাসের পেছনে দুজন হাঁটু গেড়ে বসলাম। আমার হাতে কিছু স্টাফ নোটেশন শিট ধরিয়ে দেয়া হলো, সাথে লম্বা কাগজ ভাঁজ করা একটি চাইনিজ হরফের বই; সাথে তসবি, গলার মালা ও আরো কিছু স্যূভেনির। কিয়োকো ক্ষীণ স্বরে বোঝাতে লাগলেন এগুলোর গুরুত্ব। বললেন এটি বুদ্ধিস্ট সোমিও (সৌম্য) মিউজিক। যা প্রাচীনকালে চীন থেকে সংগৃহীত, প্রায় বারোশত বছরের পুরোনো সংগীত। কণ্ঠানুশীলনের জন্য অসাধারণ এক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এর মধ্যে লুকিয়ে আছে। এই সংগীত ভারত থেকে চীন হয়ে এদেশে এসেছে। আদিকালের সেই সুরই এখানে রক্ষা করা আছে, যা চিনদেশের পর্যটকগণ লিখে রেখেছিলেন। কিন্তু আমি আসলে তখনো বিভ্রমে-বিষ্ময়ে ডুবে আছি, ভাবছিলাম এ-কোন অজানা রাজ্যে এসে পড়েছি, কঙ্কাবতী ও ডালিমকুমারের রূপকথা মনে হচ্ছিল। কে আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে! একদিকে অচেনা খাদ্য, অজানা ভাষা, অন্যদিকে এই উদ্ভট সুর ও নোটেশন, অপরিসীম শিষ্ঠাচার ও আচার-আচরণ সব মিলিয়ে এক গোলক ধাধায় আটকে যাচ্ছিলাম।