রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ভাদ্র ২৩ ১৪৩১

জাপানের পথে পথে – (পর্ব-২) নারিতা থেকে সেতাগায়া

সাইম রানা

প্রকাশিত: ২২:৫৩, ১৩ এপ্রিল ২০২২

জাপানের পথে পথে – (পর্ব-২) নারিতা থেকে সেতাগায়া

জাপানের পথে পথে (পর্ব-২)

অনেকক্ষণ ধরে আকাশে রঙের খেলা দেখছিলাম বিমানের জানলা দিয়ে। শেষরাতের নিকষ কালো আকাশের গহ্বর থেকে রক্তিম আভা ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো এবং পুরো আকাশকে লাল আলোয় ভরে তুললো। শুধু মেঘ আর মেঘ! হঠাৎ একটি মেঘের গভীর স্তর ভেঙে বিমান নীচে নেমে এলো, হায় একি! নীচে আরেক মেঘের ভূমি, যেন শুভ্র বিচান, তার উপর সারসের সাদা ডানার পালক ছড়িয়ে রয়েছে। নব্বুইএর দশকে একটি গান লিখেছিলাম,
মেঘের বিছানায় প্রভাত ঘুমিয়ে থাকে
হরিদ্রা কন্যার বেশে,
বাতাসে তার ওড়নার ঘ্রাণ নেমে আসে
আড়মোড়া ভেঙে, মেঘের পাতাল পুরে
মানুষের দেশে।


এই গানের চিত্রকল্প নিয়ে শিল্পগুরু সেলিম আলদীন বলেছিলেন, অসাধারণ লিখেছিস, কিন্তু যুক্তি ত্রুটিপূর্ণ। আমি তার কথা একরকম মেনেই নেয়েছিলাম। কিন্তু সারসের পালক বিছানো সেই ভূমিও ভেদ করে নেমে এলে যখন দেখা গেল সবুজ ভূমি জাপান। তখন শিল্পগুরুর জন্য উত্তর পেলাম, যেন আমিই ঠিক আছি।


এদিকে আলোর কীরণ মেঘের অজস্র স্তর ভেদ করে সূর্য হয়ে দেখা দিল। কিছুটা আলো বিমানের পাখায় এসে লাগছে। সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের আকাশে বসে সূর্যোদয় দেখছি। তখনি ঘোষণা এলো কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমান নারিতা এয়ারপোর্টে পৌঁছুবে। সত্যি বলতে কি, এক বছরের অপেক্ষা আমাকে জাপান সম্পর্কে বেশ উন্মাতাল করে তুলেছিল। জাপানিজ ভাষা শেখা, গান শোনা, তাদের ছবি আঁকার রীতি, সংস্কৃতি, আইন, খাদ্য-পোষাক, যাপিত জীবনের ধারা প্রভৃতি বিষয়ে অল্পবিস্তর পরিচিত হয়ে উঠেছিলাম। প্রফেসর কিয়োকো জাপানিজদের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা-বোঝার জন্য কিছু বই, এ্যালবাম পাঠিয়েছিলেন কয়েকমাস আগে। আমি নিজেও কিছু বই সংগ্রহ করেছিলাম দূতাবাস থেকে। বিশেষ করে একটি বই ‘ট্রাডিশনাল মিউজিক অব জাপান’ এই বইটি ফটোকপি করে নিয়েছিলাম, তা অনেক কাজে লেগেছিল, সে গল্প পরে বলা যাবে।


নারিতা বন্দরে নেমে ইমিগ্রেশন শেষ করে লাগেজ নিয়ে বাইরে এলাম। দেখলাম ইংরেজি অক্ষরে সাইন পেন দিয়ে লেখা ‘সাইম রানা’ নামে একটি কাগজের দুপ্রান্ত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন একজন ভদ্র মহিলা। লাল ব্লেজার ও পাতলা কাপড়ের কালো প্যান্ট, ববকাট চুলের পঞ্চাশোর্ধ এই ব্যক্তিই হলেন প্রফেসর মোতেগি কিয়োকো, যিনি জয়েৎসু ইউনিভার্সিটি অব এডুকেশন এর স্বনামধন্য প্রফেসর। ভোর সাতটা থেকে তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমার অবশ্য লাগেজ, ইমিগ্রেশন শেষ করে বাইরে আসতে সাতটা পঁচিশ বেজে গেছে।
প্রায় একবছর ধরে শত শত চিঠি বিনিময় হয়েছে তাঁর সাথে। তাতে আমার বায়োডাটাই শুধু নয় বাংলাদেশ, বাংলা সংস্কৃতির অজস্র বিষয়াদি সম্পর্কেও তিনি সমজদারিত্ব অর্জন করেছেন। পূর্বধারনায় আমার মনে হয়েছে যে তিনি একদিকে স্নেহময়ী অন্যদিকে কঠোর, নীতিবান অথচ অনুসন্ধিৎসু চরিত্রের। সম্মুখে ব্যতিক্রম কতটা, তা বোঝার চেষ্টা করছিলাম এক ঝলকেই। সামনে আসতেই লাস্য ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দিলেন। করমর্দন অবস্থায় বললেন ‘আমরা আগে একটু নাস্তা সেরে নিতে চাই।’ এই বলে এয়ারপোর্টের ভিতরেই একটি স্ন্যাক্স বারে ঢুকে পড়লাম। আমি প্রথমেই বললাম ‘ভরপুর আছি’। তিনি তড়িৎ কিছু স্ন্যাকস খেয়ে নিলেন, আর আমি এককাপ কফি। এখানে ঢুকেই কিছু শিষ্ঠাচার, সম্বোধন, সেলফ সার্ভিস এমনকি ফর্মালিটিজও চোখে পড়লো। গেটের বাইরে এসে ৩য় তলায় উঠে পার্কিং করা কার বের করলেন। মাত্র ১০দিন আগে কিনেছেন তার এই নতুন গাড়িটি। লাগেজ তুলে দ্রুত রওনা হলাম সেতাগায়া কু বা শহরের পথে। নেভিগেটর সংযোগ করলেন। নারিতা বিমানবন্দর থেকে সেতাগায়া শহর প্রায় ৯০ কিলোমিটার, যেতে লাগবে মোটামুটি দেড় ঘণ্টা। আজ আমাদের দেশেও নেভিগেটর দিয়ে গাড়ী চালানো হয়। কিন্তু ২০০৫ সালে এই ঘটনা দেখে বিস্মিতই হয়েছিলাম। কীভাবে সম্ভব!


মাঝরাতে তিনি ড্রাইভ করে এসেছেন। ফলে তাঁকে কিছুটা ক্লান্তও লাগছিল। তারপরও তিনি গতি বাড়িয়ে দিলেন ১৩০-৪০ কিলোতে। অদ্ভুত এক অনুভূতি। মাঝে মাঝে পিকপিক করে সাইরেন বেজে উঠছে গাড়ির ভিতর। বললাম ‘এই শব্দটি আসলে কীসের? উত্তরে বললেন ‘জাপানে একজন অজানা মানুষের প্রবেশ ঘটেছে। তাই তাকে স্ক্যানিং করছে। তবে অসুবিধা নাই। আমি জাপান সরকারের একজন প্রভাবশালী লোক। ফলে তোমার কোনো চিন্তার কারণ নেই।’ আমি তখন বুঝতে পারিনি, কথাগুলো রসিকতা ছিল কি, না সত্যিই। আমি বিশ্বাসই করে নিয়েছিলাম। কারণ তাদের প্রযুক্তির দৌড় সম্পর্কেও আমার কোনো ধারনা জন্মেনি।আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি প্রভাবশালী কী অর্থে?’


তিনি বললেন, ‘দেখো তোমার এই স্কলারশিপটা আসলে খুবই কমপ্লিকেটেড। সরকার সার্কুলার দিয়েছে ঠিকই, উন্মুক্ত ও স্বাধীন রেখেছে গবেষকদের জন্য, এটাও ভালো। কিন্তু একটি সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও তাদের ইন্টারেস্ট ছাড়া-এর ভালো প্রতিদান পাওয়া কঠিন। সরকারের কাছে প্রভাব না খাটিয়ে এই বৃত্তিটি বের করে আনাও অন্য কারো পক্ষে কঠিন ছিল। আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম বলেই কথা রাখতে চেষ্টা করেছি।’
‘তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।’ আমার এই কথার প্রত্যুত্তর এলো, ‘বাকী সাফল্য দেখানোর দায়িত্ব তোমার উপর বর্তায়।’


ধীরে ধীরে রাজধানী শহরে ঢুকছি। কিয়োকো বললেন, ‘তুমি টোকিওতে ঢুকলে।’ চলতে চলতে মাঝে মাঝেই বিশেষ বিশেষ স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। রাস্তার প্রতিটি পর্যায়ে দিক নির্দেশনা দেখে মাঝে মধ্যে নিজেও চিন্তিত হয়ে পড়ছিলেন। কখনো কখনো ব্যস্ত এলাকায় দুই তিন চার স্তরের ফ্লাইওভার দেখে গুলিয়ে ফেলছিলেন যে সঠিক নির্দেশনা কোনটি হবে। কিন্তু শহরের ভিতর ঢুকে দেখি, মোড়ে মোড়ে মানুষ পারাপারের জন্য গাড়িগুলোকে থামতে হচ্ছে। এদিকে নেভিগেটর থেকে বারবার আওয়াজ আসছে, ‘হিদারি দে, বা মিঙি দে’ অর্থাৎ ডানে যাও বা বামে যাও ইত্যাদি শব্দ। কোথাও কোথাও দুএকজন মানুষ রাস্তা পার হচ্ছে, অথচ মুহূর্তেই শত শত গাড়ি জমে যাচ্ছে। মনে হলো ঢাকার যানজট-এর থেকেও কত না অল্পবিস্তর। টোকিওর মধ্যস্থলে সেতাগায়া কু-তে এসে পৌছুলাম অবশেষে। তখনো দশটা বাজেনি।