রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ভাদ্র ২৩ ১৪৩১

জাপানের পথে পথে (পর্ব-১)

সাইম রানা

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ১৩ এপ্রিল ২০২২

জাপানের পথে পথে (পর্ব-১)

জাপানের পথে পথে

প্রায় পনের বছর পর লিখতে বসেছি জাপানের স্মৃতিকথা। সাড়ে নয় মাসের শিক্ষা-সময়ের অনেক কিছুই দেখছি ভুলে গেছি। অনেক শহর―অলিগলি, রাস্তা―প্রতিষ্ঠান কিংবা সান্নিধ্যে আসা বন্ধু-প্রিয়জনদের নামও মনে পড়ছে না। পরিকল্পিত ভাবে কোনো ডায়েরিও লেখা হয়ে ওঠেনি তখন। ভাষা শেখা অথবা সংগীত অনুশীলনের চাপে ভেসে গেছে সময়ের সিংহভাগ। তারপরও অনুভূতিময় অসাধারণ মনোরম দিনগুলো আমাকে টানে প্রতিক্ষণে। সেই অনুভূতির কথা লিখতে গিয়ে ছায়ার মতো ঘিরে থাকা স্মৃতির ডালপালাগুলো নতুন উপলব্ধি নিয়ে ভাবনাকে তাড়িত করছে আজ। কারণ তা ছিল প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। এরপর ডজনেরও বেশি দেশ ঘোড়া পড়লো। কিন্তু টোকিও জীবনের স্মৃতিগুলো এখনো আমাকে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে রাখে। এখনো মনে হয় জীবনের সেরা দিনগুলো রেখে এসেছি সেখানে। কোইসিকাওয়ার বাড়িটা, জোরাকোয়েন টেম্পল হয়তো কোনো স্মারক অবশিষ্ট রাখেনি। তবু মানুষ হারিয়ে গেলেও তার ছায়া থেকে যায়। অথবা কোনো প্রেমিক হৃদয়ে গাঁথা থেকে যায় অরূপরতন।
সুবর্ণভূমি : প্রথম বিদেশের মাটিতে
দিনটি ছিল ২০০৫ সালের ১০ জুন শুক্রবার। ঢাকা বিমানবন্দরে চেকিং শেষে বোর্ডিং পাশ নিয়ে উঠে বসলাম থাই এয়ারলাইনসে। আমার আনমনা মনে হঠাৎ হঠাৎ করে চমকে উঠছিল বিচিত্র বিদ্যুল্লতা। কিছু প্রিয়জনকে দেখতে ইচ্ছা জাগছিল আবার নিমেষে নিভেও যাচ্ছিল। যাদেরকে ভালবাসতে চেয়েছি এ জীবনে, আবার কারো প্রত্যাখ্যান কিংবা সহানুভূতির অভিনয় আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করে গেছে, কিন্তু তা লুকিয়ে রেখেছি হৃদয়ের গোপন কুটিরে। তবে দীর্ঘদিন ধরে এমনই একটা সময় চাইছিলাম, শুধু নিজের ভিতরে থাকার জন্য, নিজের সাথে অফুরন্ত কথা বলার ব্যাকুল আকাঙ্খায়। আজ থেকে উন্মুক্ত হলো সেই দুয়ার। চিৎকার করে তা প্রকাশ করা যাবে এবার।
কৈশোর ও তারুণ্যে অজস্র প্রত্যাখ্যান কিংবা করুণা আমাকে সত্যিই হাঁপিয়ে তুলেছিল। জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ফাঁকে ফাঁকে ঢুকে পড়া ফাঁদ আটকে রেখেছিল অনেক অদৃশ্য জালে। পুরোনো মায়ার জাল, নতুন মায়ার ফাঁদ, তা থেকে মুক্তির আনন্দ, এ তো পালানোই। জীবনের দিকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিইবা বলা যাবে তাকে। কিংবা মানুষের মুখ থেকে অজস্র মুখোশ খসে পড়ার পর কদাকার চরিত্র আবিষ্কারের মতো এক অদ্ভুত আনন্দ, যা আমার ভেতরটাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। নিজেকে বদলে ফেলা কিংবা মানুষ যে যাযাবর, এক বন্ধন থেকে অন্য বন্ধনে নিজেকে নতুন নতুন ভাবে নির্মাণ করার দিকে সমর্পণ। সেই নির্মাণের আনন্দ আমাকে সূদূরেই টানছিল। মায়া যে কখনো কখনো মন্দ, তা আমি তারুণ্যেই জেনে গেছি।
ব্যাংককের বিমানবন্দরে একটি বেঞ্চে বসে আছি। শ্যামবর্ণের এক মোটাসোটা ভদ্রলোক বেঞ্চের ওপ্রান্তে বসলো। গায়ে গাঢ় নীলশার্ট এবং কালো খাকি প্যান্টে ইন করা বেঢপ প্রশস্ত বেল্ট । আমি তার দিকে চাইলে সে আমার দিকে বাঁকাভাবে একটু তাকিয়েও না দেখার ভান করে চোখটা ঘুরিয়ে নিল সামনের দিকে। মুখে কিছু একটা চিবুচ্ছিল। ঈষৎ হাসি রেখে বললাম আপনি কি বাংলাদেশী। সে বললো ’না আমি ইন্ডিয়ান।’ আরেকটু জানতে চাইলাম ’ইন্ডিয়ার কোথায়?’ উত্তর এলো ‘ব্যাঙ্গালুরু’। ‘আচ্ছা।’ এটুকু ইংরেজিতেই চলছিল, এবার সে সরাসরি হিন্দিতে চলে গিয়ে বললো ’তুমি কি হিন্দি বোঝ?’ বললাম ‘অল্প অল্প। শুনলে বুঝি কিন্তু বলতে পারি না। তুমি কোথায় যাচ্ছো?’, জবাব এলো ‘মালয়েশিয়া, আমি ইঞ্জিনিয়ার, তুমি?’ আমি বললাম ‘সংগীত শিল্পী’।
কথা এর বেশি এগুলো না। মুখে কোনো হাসি বা কৌতুহলও দেখলাম না। কি যেন চিবিয়েই চলেছে তখনো, পান-মশলা জাতীয় হবে কিছু একটা। কিছুক্ষণ পর আরেকজন হন্তদন্ত হয়ে এসে মাঝখানে বসার জন্য আমার দিকে তাকিয়ে একটু বিনীত চোখে অনুমতি চাইল। আমি হ্যাঁ সূচক ইশারা করলে বসতে বসতেই সে আমাকে বললো, ‘ধন্যবাদ, তুমি কি ইন্ডিয়ান?’ আমি বললাম ‘না আমি বাংলাদেশী।’ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো ‘আমি হিশাম, শ্রীলংকান।’ হিশাম জিম-এর ব্যবসা করে, সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়ায়, নিজেদেরই জিম-এর খনি রয়েছে বললো। আমি জানতে চাইলাম তার কাছে কোনো স্যাম্পল আছে কি না। সে তার ওয়ালেট খুলে পনেরো বিশটা নানাবর্ণের পাথর দেখালো। বন্ধুপ্রিয় মানুষ। আমাদের বিস্তারিত পরিচয় সম্পন্ন হলো। সে মুসলিম এবং আমরা একই ধর্মানুসারী বলে আমার প্রতি তার বিশেষ আন্তরিকতা প্রদর্শন করতে দেখছিলাম, শুধু এইটুকু মনে হলো সে তার দেশে সংখ্যালঘু বিধায় আচরণে ধর্মীয় পরিচয়ে ভ্রাতৃত্বের দিকটি বড় করে দেখছে। সাধারণত যে কোনো দেশের সংখ্যালঘুর ক্ষেত্রেই স্বজাতি কিংবা স্বধর্মীর প্রতি প্রীতিমূলক এধরণের আচরণ দেখা যায়। সে তার দেশে ফিরছে অনেকদিন পর, আর আমি দেশ ত্যাগ করছি অনেক দিনের জন্য। ঘণ্টাখানিক পর উঠে যাওয়ার সময় পকেট থেকে বেশকিছু থাই বাথ কয়েন ও নোট এবং একটি মার্লবোরো প্যাকেট বের করে আমার হাতে গুঁজে দিলো। আমি নিতে অস্বীকার করলেও সে নাচোড় বান্দার মতো বিনীত স্বরে বললো, ‘দেখো ভাই, তোমাকে এখানে আরো চারপাঁচ ঘণ্টা বসে থাকতে হবে। ফলে নিঃসঙ্গ লাগবে। ক্ষুধা পেলে আশপাশ থেকে কিছু একটা খেয়ে নিতে পারবে। আর আমিতো দেশে ফিরছি। এই অর্থ আমার তো আপাতত কোনো কাজে আসছে না।’ ট্রানজিট টাইম যে সত্যিই অস্বস্তির তা প্রথম অনুভবে এলো।
ছয় ঘণ্টা অপেক্ষার পালা শেষে জাপান এয়ারলাইনস জাল-এ চড়ে বসলাম। পরিচ্ছন্ন কালো আকাশের উপরে তারকারাজি জ্বলছে, নীচে নিয়ন আলোয় ঝলমলে ব্যাংকক। কিছুক্ষণ পর রাতের খাবার এলো। মাছ, ভাত, পুডিং ও পায়েস জাতীয় খাবার। সাথে নিলাম এক পেয়ালা ব্র্যান্ডি। চপস্টিক এবং চামচ উভয়ের মধ্যে প্রথমটিই বেছে নিলাম। আনাড়ি হাতে দুটি কাঠির কসরত করতে করতে সারাদিনের ক্লান্তি এসে ভর করলো চোখে। তারপর ঘুম…

 

 

লেখক একসময় জাপান প্রবাসী ছিলেন,
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
একজন শিক্ষক এবং সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ।