রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ভাদ্র ২৩ ১৪৩১

প্রেম কি বুঝিনি

অংশুমালী বর্ম্মন -বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

প্রেম কি বুঝিনি

ছবি- সংগৃহীত

জীবনে প্রথম প্রপোজ করেছিলাম সায়নী কে। আমার চেয়ে ও এক বছরের জুনিয়র। দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিল সে। আমি তখন এস এস সি দিয়েছি। দীপ কাকু বলল, বসে থেকে কি করবে। বাংলা টা হামিদ স্যারের কাছে পড়। কাকু পরিচয় করিয়ে দিলো স্যারের সাথে এক ফাগুনের বিকেলে। স্যারের বাসা ছিল মাইক্রো স্ট্যান্ড এর উত্তর পাশে। কৃষ্ণচূড়ার গাছটির নিচে একটা রুমে ওনি পড়াতেন। প্রথম পরিচয়ে স্যারকে খুব ভাল লাগলো। বললেন, সকাল সাতটার পর সাড়ে ন'টার মধ্যে যেকোনো সময় যেতে। আমিও তার পর দিন থেকে পড়তে যাওয়া শুরু করলাম। পড়ছি ব্যাকরণ অংশ। ঠিক সে সময় পড়েছিল গ্রীষ্মের ছুটি। সায়নীদের কোচিং এর সময় বিকালের পরিবর্তে সকালে করা হয়েছিল। একদিন বাসে উঠেছি। রাস্তায় দেখলাম অনেক গুলো মেয়ে বাসে উঠার জন্য হাত দিয়ে বাস থামানোর জন্য ইশারা করছে। তাদের মধ্যে দেখতে পেলাম সায়নী কে। আমার সায়নী। যাকে আমার ভালো লাগতো অনেক আগে থেকে। কিন্তু কখনও তাকে বলতে পারি নি। সে হয়তো বুঝতো। কারণ মেয়েদের সিক্সথ সেন্স ছেলেদের তুলনায় একটু বেশি স্ট্রং। যাক সে কথা, ফর্সা গায়ের বরণ, নাক মুখ চোখ সব মানানসই। চমৎকার একটা মেয়ে সায়নী। মুগ্ধ চোখে তাকে দেখছি। ও ওর বান্ধবীদের সাথে বাসে উঠলো। তারপর যখন নামলো তখন তাকে ডাকলাম, সায়নী, কি খবর। আজ থেকে কি সকালে কোচিং। সায়নী বলল, হু, যতদিন গ্রীষ্মকালীন ছুটি ততদিন সকালে।
সেদিন আর কোন কথা হয় নি।

পরদিন আবার পড়তে গেলাম। সায়নী আর ওর বান্ধবীরা যেখানে বাসে উঠে সেখানেই উঠল। আমার পাশের সিট টা খালি ছিল। সায়নী আমার পাশে বসলো। আমাকে বললো, কেমন আছেন। বললাম, ভালো আছি। আপনি না এস এস সি দিলেন। রেজাল্ট তো হয় নি। কি পড়েন। আমি মনে মনে বললাম, তুমি তো আর জানো না সায়নী, আমি পড়া শুরু করেছি বলেই তো তোমাকে এত কাছে পেয়েছি। এত পাশে। তোমার চোখের মনিতে নিজের ছবি দেখছি। নিজেকে দেখছি।
বললাম, বাংলা ব্যাকরণ পড়ি।
ওহ্। ভালো তো। সেদিন সায়নী নীল রংয়ের একটা কামিজ, আর আকাশী রংয়ের ওড়না পরে এসেছিল। কপালে নীল টিপ। আমি যে তাকে দেখছি, ও সেটা আড় চোখে দেখে নিল।
আমি বললাম, কখন শেষ হবে কোচিং।
সায়নী বলল, সাড়ে ন'টায়। আমার বান্ধবীদের দশটায়।
কেন, তোমার আবার আগে কেনো?
আমার কম্পিউটার সাবজেক্ট তাই, আর বাকিদের ইলেকট্রিক্যাল।
একলা একলা আসতে পারবে বাস স্ট্যান্ডে।
সায়নী অবাক চোখে আমার দিকে তাকালো, যেন বলতে চাইলো, আমি কি কচি খুকি নাকি। যে আসতে পারবো না। মুখে কিন্তু কিছু বললো না।
আমি বললাম, আমি অপেক্ষা করবো।
ও আর কিছু বললো না। ততক্ষণে বাস স্ট্যান্ডে এসে গেছে। এবার নামতে হবে। নেমে পড়লাম। সায়নী আর ওর বান্ধবীরা হেঁটে যাচ্ছে।
আমি তাদের পিছনে পিছনে যাচ্ছি। যদিও মেয়ে মানুষের পিছনে হাঁটার মতো মানুষ আমি না। কিন্তু কি আর করা যাবে। ঐ মেয়েদের সাথে আমার সায়নী আছে। তখন মে মাসের গরম পীরগঞ্জের আকাশে বাতাসে। মাঝে হঠাৎ যদি একটু বৃষ্টি হয় তো, প্রচন্ড রোদ থাকে প্রতিদিন। হামিদ স্যারের ওখানে পরিচিত হই এনথনি ভাইয়ের সাথে। এনথনি ভাই, আমাকে দেখে বলে, আরে তুমি কি প্রিন্স এর ভাই। আমি বললাম, নাতো, আমি অংশুমালী। ভাই বললো, তোমার মতো দেখতে আমার বন্ধু প্রিন্স। যশোর বাড়ি। আগে এখানে থাকতো, পীরগঞ্জে। রশনী দার সাথে পরিচয় হলো। অনেকের সাথে পরিচিত হলাম। হেলাল ভাই। অনেকের নাম এতদিন পরে আর মনে করতে পারছি না। সেদিন আমি অপেক্ষা করছিলাম সায়নীর। সাড়ে ন'টা বাজতেই সায়নীকে আসতে দেখলাম। আমার কোচিং সেন্টার থেকে একটু পশ্চিমে ওর কোচিং সেন্টার। ও বাড়ির দিয়ে রওনা দিলে আমার কোচিং সেন্টার ক্রস করে যেতে হবে। সায়নী কাছাকাছি আসতে আমিও বের হলাম। সায়নী হয়তো মনে মনে আমাকে খুঁজছিল। কারণ আমাকে দেখার পর তার অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি শান্ত হয়ে গেছিল। আমি আর সায়নী এখন পাশাপাশি হাঁটছি। আমাদের সামনে এক স্বপ্নীল পৃথিবী। আমি চিরদিন এভাবেই তোমার পাশাপাশি হাঁটতে চাই সায়নী। আমার কল্পনার জগতে ছেদ পড়লো সায়নীর কথায়। বললো, কিছু বলছেন না যে। আমি কি বলবো সায়নী। সব কথা কি বলে দিতে হয়। কিন্তু সায়নীকে বললাম, কি আর বলবো। তোমাকে তো বলতে ইচ্ছে করে অনেক কিছুই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বলতে পারি না।
সায়নী এমন ভাব করলো, যেন সে অবাক।
কি বলতে পারেন না।
আজকে বলেন। এখন কেউ তো নেই। বলেন।
না, আজকে না, কালকে বলবো। তখন আমার বুক ধুঁকপুঁক ধুঁকপুঁক করছে। এই বুঝি কন্ঠস্বর কেঁপে উঠবে। হঠাৎ আমি এত ভয় পাচ্ছি কেন। বুঝতে পারছি না।
তখন বাস স্ট্যান্ডে আমরা পৌছে গেছি। টিকিট কেটে লোকজন বাসে উঠছে। আমরা কাছাকাছি নামবো। তাই আমাদের টিকিট লাগবে না। কন্ট্রাক্টরের হাতে টাকা দিতে হবে। আমরা দু জনে আরেকটু হেঁটে সামনে ব্রিজটার ওখানে গেলাম।
সায়নী বললো, উফঃ কি গরম। আসলেই তখন অনেক গরম করছিল। শেষ বৈশাখের কড়া রোদ যেন পৃথিবীর সব কিছু ঝলসে দিতে চাইছে। কাক ডাকছে। ভ্যান, রিকশা রাস্তা দিয়ে চলছে। আর আমরা, আমি আর সায়নী একটা কড়ই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। অপেক্ষা করছি, কখন বাস ছাড়ে।

বাড়ি এসে ভাত খেলাম। পুঁইশাক ঝোল আর টেংরা মাছ ঝোল। তখনও আমার মোবাইল ছিল না। কারো সাথে যোগাযোগ করতে হলে সরাসরি দেখা করতে যেতে হবে। এছাড়া আর অন্য কোন উপায় নেই। তখন বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই ভাললাগা ভালবাসার প্রথম পাঠ শিখে ফেলেছে। আমি এ বিষয় টাতে অতি আনাড়ি। ভাবলাম কারো সাথে পরামর্শ করতে হবে। কার সাথে পরামর্শ করি, শাওন কে বললে কেমন হয়। আমি শাওনের বাসায় গেলাম। বাসায় কেউ ছিল না। ভাল মন্দ জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব শেষে তাকে বললাম আমার সায়নীর কথা। বললো, এটা কোন ব্যাপার না। বলতে প্রবেলেম হলে, চিঠি লিখে দিতে।
আমি বললাম, বাবা(ফ্রেন্ড হলেও ভাতিজা, তাই তাকে বাবা কিংবা বাজী করে সম্বোধন করি) আমি তো কাউকে কখনো কোনো চিঠি লিখি নি। তো কি যে লিখবো, বুঝতে পারছি না।
শাওন বললো, ঠিক আছে, আমি একটা খসড়া লিখে দিবো। বা হুবহু সেটা নিজ হাতে লিখে দিলেও হবে।
আমি বললাম, ঠিক আছে, বিকালে তাহলে নিতে আসবো। শাওন বলল, ঠিক আছে, বাজারে দেখা হবে।
সেদিন বিকালে স্কুল মাঠে শাওনের কাছ থেকে চিঠির খসড়া নিলাম। বাড়ি এসে পড়ে দেখলাম। নাহ্, বেশ ভালো লিখেছে। এতটা কাউকে নিয়ে লিখতে পারা যায়, আমি আগে জানতামই না। যাক, ঘুমানোর আগে আবার চিঠির খসড়া পড়লাম।
প্রিয়তমা সায়নী,
চিঠির প্রথমে আমার হৃদয়ের বাগানে অতি যত্নে লালন করা এক বাগান টকটকে লাল গোলাপের শুভেচ্ছা। আশা করছি ভালোই আছো।
তারপর বাকি অংশটাও পড়লাম। চিঠিতে যতটা ভাললাগা ভালবাসা ফুটে উঠেছে ততটা আমি তাকে ভালবাসতে পেরেছি কিনা জানি না। তারপরও নিজ হাতে যতটা হাতের লেখা সুন্দর করা যায়, সেভাবে লিখলাম। ভাঁজ করে পকেটে রাখলাম। কালকে দিবো সায়নী কে। ঘুমাতে গেলাম। ভাবতেছি, চিঠি দেওয়া টা কি ঠিক হবে। ওকে তো আমি বলতে চেয়েছিলাম। অনেক অনেক ভাবলাম আমি। সব শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম। আর যা হয় হোক। সরাসরি বলবো।
বাইরে বাবা-মা কথা বলছে। তখন অনেক রাত। বাইরে জোসনায় যেন বান ডেকেছে।

ঘুম ভাংলো পাখির কিচির মিচির শব্দে। আমাদের বাড়ির আঙ্গিনায় অনেক গুলো গাছ, আম, কাঁঠাল, মেহগনি, নিম, জলপাই, কামরাঙা, বরই, চালতা আরো অনেক গাছ। এ গাছ গুলোতে অনেক পাখির বাসা। পাখির ডাকে আমার রোজ ঘুম ভাঙ্গে। রোজ কার মতো যথা সময়ে পড়তে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলাম। আমার পকেটে গত কালকের চিঠি। যদিও চিঠি সায়নী কে দিবো না ডিসিশন নিয়েছি। আমাদের গ্রামের বাজারে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। বাস এলে উঠে পড়ি। কিছুদূর যেতেই সায়নী আর ওর বান্ধবীরা বাসে উঠে। আমি বুঝতে পারি, আমার হৃদয় আগের মতো স্বাভাবিক নেই। কেঁপে চলছে একটানা। আমার এরকম অনেক বার হয়েছে। স্কুলে যখন ফাংশন হয়, গীতা পাঠ করার জন্য আমার ডাক পরে। যতক্ষণ পর্যন্ত মঞ্চে না গেছি। ওঁ ভগবতে বাসুদেবায়, না বলেছি, ততক্ষনই পর্যন্ত আমার বুকের ধুঁকপুঁকানি চলতেই থাকে। মনে হয় ভূমিকম্প হচ্ছে, এই বুঝি সব ভেঙে পরবে। সায়নীকে দেখতে পেয়ে আমার অবস্থা তেমন। যদিও সে আমার থেকে একটু দূরে বাসের সামনের দিকে মহিলাদের সংরক্ষিত আসনে।
যথা সময়ে বাস থেকে নেমে পড়লাম। হাঁটছি কাছাকাছি, এক প্রকার পাশাপাশি।৷
সায়নী বলল, কি ব্যাপার, কেমন আছেন।
এই তো বেঁচে আছি, সায়নী।
খুব দুঃখী দুঃখী মনে হচ্ছে। ও কি যেন বলতে চাইছিলেন। বলেন।
আমি ফিসফিস করে বললাম, তেমার বান্ধবীদের সামনে, অসম্ভব।
তো কখন বলবেন, কি বলবেন। টেনশনে ফেলে দিছেন।
তোমার কোচিং শেষ করে এসো, একসাথে যেতে যেতে বলবো।
আচ্ছা, বলে চলে গেল সায়নী। আমি আমার কোচিং এ ঢুকলাম। আমি কোচিং এ ঢুকতেই স্যার বলল, কি ব্যাপার অংশু, প্রতিদিন তোকে ঐ এক ঝাঁক মেয়েদের সাথে আসতে দেখি। সবাইকে নিয়ে আসিস নাকি রে।
না স্যার, আমি আবার মেয়েদের নিয়ে আসবো কেমনে, দেখেন তো, আমি ওদের পিছনে পিছনে আসি। বলতে গেলে এক প্রকার ওরাই আমাকে নিয়ে আসে। স্যার সমাস পড়াচ্ছেন। আমরা এখন সাত জনের মতো আছি। আমি, দুই শিল্পী, শিলা, রশনীদা, আর দুই জনের নাম মনে পড়ছে না। আমি বাদে ওরা সবাই সিনিয়র। এখানে বলে রাখা ভালো স্যারের কোচিং এ অনেক মজা হয়। এক প্রকার মজায় মজায় শেখা।
কোচিং শেষ করে বের হচ্ছি। দেখি সায়নী আসছে। আমি সায়নীর জন্য দাঁড়িয়ে আছি। ও আসতেই, একসাথে হাঁটছি।
তখন কি যেন বলবেন, এখন বলেন। এখন আমার বান্ধবীরাও নেই। চোখে চোরা হাসি। বুঝতে পারছি ও মিট মিট করে হাসছে। সায়নীকে এ রকম হাসতে দেখতে খুব ভাল লাগে।
বললাম, তোমাকে তো অনেক কথাই বলতে চাই। হয়তো তুমি বুঝতেও পারছো, আমি কি বলতে পারি।
নাহ্, বুঝতে পারছি না। বলেন, বললেই তো বুঝতে পারবো। বলবো, কিন্তু শুনে তুমি আবার রাগ করবে না তো।
নাহ্, কেন রাগ করবো। আর রাগ করার কথা কেন বলবেন আমাকে।
নাহ্, রাগ করার কথা বলবো না। তাপরও বলছি।
রাগ করার কথা হলে রাগ তো করবোই।
তোমাকে আমার অনেক ভাললাগে সায়নী।
কেন যে ভাল লাগে বুঝতে পারি না।
সায়নী বলল, কেন ভাললাগে বুঝতে চেষ্টা করেন।
কি জানি, বয়সের দোষ নাকি। ঠিক জানি না।
তবে অনেক ভাললাগে তোমাকে।
এখন ভালো লাগে, পরে যদি ভাল না লাগে।
আমি অতশত জানি না সায়নী। আমি শুধু জানি তোমাকে আমার ভাললাগে, আর তুমি আমাকে কি বলবে, আমি জানি না। তুমি তোমার কথা আমাকে কালকে বলো। আর কাল না বলতে পারলে পরশু বলবে।
আমরা এর মধ্যে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে যাই। আর বাসও যেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমরা বাসে উঠতেই বাস ছেড়ে দিল।
তারপর দিন ছিল শুক্রবার। তাই সায়নীর সাথে দেখা হওয়ার সুযোগ নেই। শনিবার দেখা হলো, সায়নী আমাকে বললো, আমি আগে এস এস সি এক্সাম দিই। যেদিন রেজাল্ট হবে, সেদিন আমি আপনাকে বলবো। আমি এক্সামের আগে এসব নিয়ে ভাবতে পারবো না। ভালো থাকবেন।
আমি বলেছিলাম, ঠিক আছে সায়নী, আমি অপেক্ষা করবো।
এরপর পুরো এক বছর কেটে গেছে। সায়নীর এস এস সি র রেজাল্ট বের হয়েছে। গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে সে। আমাকে খবর দিয়েছে, আমি যেন তার সাথে দেখা করি। কিন্তু আমি সায়নীর সাথে আর দেখা করি নি। এক বছরে আমি অনেক ব্যস্ত হয়েছি। আমার বাবা পরপারে চলে গেছে। আরো অনেক কিছু ঘটে গেছে জীবনে। এ এক বছরে আমি শুধু এটুকু উপলব্ধি করেছি, যে মেয়ে আমাকে তার হ্যাঁ, না, বলতে এক বছর কাটিয়ে দেয়। সে আর যাই হোক, আমাকে মন থেকে ভালবাসতে পারে না।

 

অংশুমালী বর্ম্মন