ছবি- সংগৃহীত
বৃষ্টি, কদমফুল আর রবীন্দ্র সঙ্গীত এই তিন শব্দই যথেষ্ট পেখমের জন্য। পেখম নামটা ওর বাবার দেওয়া। ১৯৯৭ সালের ৯ জুলাই, বাংলা সনের ২৬শে আষাঢ় প্রচণ্ড এক ঝড়-বৃষ্টির দিনে বাঁধাঘাটের ওদের ওই সাবেকি বাড়িতেই জন্ম পেখমের। শৈশবের বেশ কিছুটা সময় ও বাড়িতেই কেটেছে পেখমের। নয় বছর বয়সে বাবার জবের জন্য খুলনায় শিফট হতে হয়েছে। পেখমের বাবা এখন সরকারি ব্রজলাল কলেজের বাংলার সহযোগী অধ্যাপক। পেখমের যে রবীন্দ্রপ্রেম সেটা খানিকটা বাবার কাছ থেকেই পাওয়া বলা চলে।
মেয়েটা চিরদিনের বৃষ্টি পাগল। পেখমের সাত বছরের জন্মদিনের দুপুরে ওকে খেলতে বসিয়ে ওর মা রান্না ঘরে পায়েস রান্না করছিলো। দমকা হাওয়ার সাথে বেশ বৃষ্টিও হচ্ছে সেদিন। তখনও পর্যন্ত মফস্বলের বাড়িগুলোতে জন্মদিনের সেলিব্রেশনে পায়েস একটা অপরিহার্য অংশ ছিলো। আসলে আমরা তো প্রচণ্ড অন্ধ অনুকরণ প্রিয় জাতি। কতটুকু অন্যের থেকে গ্রহণ করা উচিত আর কতটুকু বর্জন করা উচিত সেটা না ভেবে শুধু হালের ট্রেন্ডে গা ভাসাই। তাই বলে এটা ভাববেন না পেখেমের বাবা কেক কাটার বিপক্ষে ছিলেন। পায়েস পরিবেশনের জন্য সিরামিকের ছোটো বাটিগুলো আনতে গিয়ে দেখে পেখম রুমে নেই। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে দেখা গেলো হাতে একগুচ্ছ কদমফুল নিয়ে চোখ বুঝে ছাদে বৃষ্টিতে ভিজছে।আসলে ওদের বাড়ির পাশের প্রকাণ্ড বড়ো কদম গাছের কিছু ডাল ছাদের উপর এসে পড়েছে। সেখান থেকে চাইলে পেখম অনায়াসেই ফুল ছিঁড়তে পারে। তারপর থেকে সিঁড়ির ঘরের দরজায় তালা ঝুললো।
আজকের এই বৃষ্টির দিনের অলস দুপুরে বসে কত না কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে পেখমের। অনেক দিন পরে এসেছে এই বাড়িতে। বাড়ি বলতে দেখাশোনা করার জন্য এখন শুধু একজন কেয়ারটেকার আছে। ওর বাবা চেয়েছিলো বাড়িটা ভেঙে নতুন ফ্ল্যাট বাড়ি করবে। কিন্তু পেখম বাঁধ সাজায় তা আর হয়ে উঠেনি। পেখম মজা করেই বলে তোমার পরে আমিই তো এইবাড়ির মালিক।শেষ বয়সে এখানে এসে বিশ্রাম নিবো আর প্রাণ ভরে চিত্রাকে দেখবো। বাড়ির সামনের চিত্রা নদী পেখমের অন্যতম আকর্ষণ। ওর বাবা বলে আচ্ছা তা বেশ, কিন্তু ডাক্তারিটা তো মন দিয়ে করতে হবে। তার জন্য পড়াশোনাও তো দরকার কিছুটা। সেই যে কবে এসেছিস রোজার ছুটিতে, এখনও পর্যন্ত তো বই ধরতে দেখলাম না।
পেখমের বাবা পেখমকে অবাধ স্বাধীনতা দিলেও পড়াশোনা নিয়ে আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবাদের মতো ছাড় দেয় না। জানি না কেন সচরাচর আমরা বাবাদের এই মানসিকতাকে দোষারোপ করে থাকি। আসলে তাদের এই মানসিকতাকে কি দোষারোপ করা চলে? চলে না হয়তো। হ্যাঁ, তবে পেখম স্বাধীনতার স্বেচ্ছাচারিতা করে না। মেডিকেলে পড়া পেখমের নিজের ইচ্ছায়। এইচ.এস.সি এর পরে বাবা বলেছিলো তোমার যেটা ইচ্ছা, আমাদের কোনো অসুবিধা নেই।
বাড়িতে আসলে খুব একটা মেসেনজারে এক্টিভ থাকে না পেখম। ওর বান্ধবী দীপাকে মেসেজ করার জন্য মেসেনজার ওপেন করতেই দেখে রণক বর্ষার শুভেচ্ছা জানিয়ে মেসেজ দিয়েছে, 'আষাঢ়ের এই প্রথম দিনে সহস্র কদমের মাতাল ঘ্রাণে তোমাকে জানায় ময়ূর পেখমে নববর্ষার শুভেচ্ছা'।রণকের সাথে সামনাসামনি যতটুকু কথা হয়েছে তাতে করে ছেলেটাকে একবারের জন্যেও পেখমের সাহিত্যমনা বলে মনে হয়নি। আচ্ছা, মানুষ চেনা কি খুব সহজ? আমার তো মনে হয় পৃথিবীর রহস্যময় থেকে অধিকতর রহস্যময় জীব হলো মানুষ। খুব বিব্রত লাগলো নিজের কাছে ওর। চারদিন আগের মেসেজ এখনও সিন করা হয়নি। কী ভাববে রণক? আবার ভাবে যেহেতু মেসেনজারে ওকে এক্টিভ দেখেনি সেহেতু কিছুই ভাববে না। আচ্ছা, পেখম কেন এত শত ভাবছে? নিজের মনে নিজেকে প্রশ্ন করে লজ্জা পায়?
ছোটো করে মেসেজের উত্তর দেয়, ধন্যবাদ, আপনাকেও নববর্ষার স্নিগ্ধ জলরাশির পরশে তপ্ত মাটির সোঁধা ঘ্রাণে জানাই আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের শুভেচ্ছা।
এই বাড়িতে আসলে বিকালে কফি নিয়ে ছাদে উঠতে না পারলে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে পেখমের। কিন্তু আজ আর উঠা হবে না। ভাবছে সন্ধ্যায় হারমোনিয়ামটা নিয়ে বসবে। রেওয়াজ করাটা তো প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে মেডিকেলে যাওয়ার পরে। কেন জানি না আজ অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে ওর। অনেকটা ভালোলাগা আবার অল্প ভয়। ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। পেখমের বাবা রূপগঞ্জ থেকে আসার সময় ওর পছন্দের খাসির মাংসের চপ, চুইঝাল দিয়ে ছোলা রান্না নিয়ে এসেছে। সবাই মিলে বসে ছোলা, মুড়ি, চপ আর ধোঁয়া উঠা গরম চায়ের কাপে চুমুক না দিলে কীসের বর্ষাকালের মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের সন্ধ্যা। অবশ্য তার জন্য পেখমের মা কিছু মালপোয়াও বানিয়েছিলো।
ঘড়ির কাটাতে রাত এগারোটা। মফস্বলে রাত এগারোটা মানে বেশ রাত। এই বাড়িতে পেখমের একটা ডায়েরি রাখা আছে। ছুটির প্রতিটা দিনের টুকটাক কথা লিখে রাখার চেষ্টা করে সে। আজ কি ডায়েরির পাতায় আর একটা নতুন নাম সংযুক্ত হবে? নাকি আগে হৃদয়ের খাতায়? এসব ভাবনার দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মাঝে পালঙ্কে বসে পুরনো লেখাগুলো পড়তেছিলো। এমনই এক আষাঢ়ের বৃষ্টির রাতে ওদের এই বাড়ির ছাদে উঠেছিলো ভিজতে।প্রচণ্ড পেট ব্যথায় সেদিন ঘুমাতে পারছিলো না পেখম।ভেবেছিলো বৃষ্টিতে ভিজলে কিছুটা স্বস্তি মিলবে। কিন্তু কখন যে বৃষ্টি আর দেহের ধারায় আরও একবার নারীত্বের প্রমাণ পেয়েছিলো বুঝতে পারিনি। ঝরা কদম আর বৃষ্টির জল স্বাক্ষী হয়েছিলো সেদিন। রক্ত দেখে পেখম অবশ্য খানিকটা ভয় পেয়েছিলো। তবে এদেশে বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েরা যতটুকু বা সাপোর্ট পায় পরিবার থেকে ছেলেদের ক্ষেত্রে তাও জোটে না। সেদিনের ওই লেখা পড়তে পড়তে লজ্জায় লাল হয়ে উঠে পেখম। ফোনটা সাইলেন্স করে পাশেই রাখা ছিলো। ক্লাসে মোবাইল সাইলেন্স রাখতে রাখতে ইদানিং অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। স্ক্রীনের আলো জ্বলতেই দেখলো রণকের মেসেজ, তোমার ক্যালেন্ডারে আজ বুঝি প্রথম আষাঢ়স্যা দিবস?
পরে একটা হাসির ইমোজি। বেচারা পেখম কী বলবে বুঝতে পারছে না। জানালো, বাড়িতে এলে খুব একটা ফেসবুক মেসেনজারে আসা হয় না। এজন্য খেয়াল করিনি, দুঃখিত।
-আরে না, ঠিক আছে। তো, বাসার সবাই কেমন আছে?
-হ্যাঁ, সবাই ভালো আছে। আপনার বাসায়?
-ওটিতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত যতদূর জানি ভালোই।এখন আবার কথা বলতে হবে। মায়ের অভ্যাস ঘুমানোর আগে একবার আমার সাথে কথা বলা।
-হুম, মায়েরা তো এমনই হয়। আপনি তো মাত্র ওটি শেষ করলেন। ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিন তাহলে।
-আর রেস্ট, বছর দুই পরে বুঝবে ইন্টার্নশিপে রেস্ট কী জিনিস।
-হ্যাঁ, অনেক কষ্ট শুনেছি।
-হ্যাঁ কষ্ট, আনন্দ সব মিলিয়ে আর কী। যাই হোক এখন আসি। শুভরাত্রি, ভালো থেকো।
-শুভরাত্রি, আপনিও ভালো থাকবেন।
পেখমের মনের রাজ্যে কত শত প্রশ্নেরা উঁকি দিচ্ছে। এই তো মাস দুয়েক আগে মেডিসিন ওয়ার্ডে ও যখন বেডসাইডে রেসপেরটরি সিস্টেমের এক্সামিনেশন প্রাক্টিস করছিলো তখনই রণকের সাথে পরিচয়। palpation টা ভুল করছিলো পেখম, রণকই এসে বুঝিয়ে দিয়েছিলো সেদিন। আর এর মধ্যে দুইটা মাস কেটে গেলো।
ছোটবেলা থেকেই পেখম আর্লি রাইজার। কিন্তু বাড়িতে এলে ওর বাবা বলে ওখানে তো রাত জেগে পড়তে হয়। বাড়িতে এই কয়েকটা দিন একটু বেশি করে ঘুমিয়েনে।কিন্তু আজ বাবার কবিতা আবৃত্তি শুনে একটু আগেই ঘুম ভাঙলো পেখমের। ও নিজেও এসে গলা মিলালো কবিগুরুর কবিতায়,
আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর,
কেমন পশিল গুহার আঁধারে
প্রভার-পাখির গান।
থর থর করি কাঁপিছে ভূধর
শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে
ফুলিয়া উঠিলো ফেনিল সলিল
গরজি উঠিল দারুণ রোষে।
রবিঠাকুর পেখমের কাছে এক অন্যরকম মুগ্ধতা।পেখমের বাবা বললো, তোর মোবাইলটা নিয়ে আয় মা। বাবা-মেয়ের আবৃত্তি করা কবিতাটা রেকর্ড করে রাখি।তুই যখন বরিশাল থাকবি তখন শুনবো।
পেখম বলে, তা বেশ কিন্তু ভিডিও কলেও তো আমি তোমাকে কবিতা শুনাতে পারি।
পেখমের বাবা বলে, সে পারিস, কিন্তু আমার যখন শুনতে ইচ্ছা করবে তুই যদি ফ্রি না থাকিস।
আচ্ছা, ঠিক আছে বলে পেখম মোবাইল নিতে ওর রুমে যায়। রণকের মেসেজ, সুপ্রভাত, মেঘভাঙা রৌদ্রের মতো হাস্যোজ্জ্বল হোক তোমার দিনগুলি।
প্রত্যুত্তরে পেখম শুধু শুভসকাল লেখে। আজকের সকালটা সত্যিই অন্যরকম। বাড়িতে আসার পর আজই প্রথম বাবার সাথে গলা মিলিয়ে কবিতা আবৃত্তি করলো। ওর পছন্দের মায়ের হাতের খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজা। আর কোনো একজনের দেওয়া সুপ্রভাত মেসেজ।
বিকালে কফি নিয়ে ছাদে উঠেছিলো পেখম। সকালে রোদে উঠলেও পরে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছিলো। দুপুরের পর বৃষ্টিটা কিছুটা কমেছে। সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস থেকে ফোন এসেছে তার। রীতিমত অবাক হওয়াটা স্বাভাবিক ওর জন্য। ও কুরিয়ার অফিস থেকে ফোন দেওয়া লোকটাকে বললো, আপনার বোধ হয় কোনো ভুল হচ্ছে। লোকটি জানায়, না ম্যাম, পেখম সেনের নামেই পার্সেলটি, আর পাঠিয়েছে রণক সেন।ভালো লাগার সাথে সাথে বেশ কৌতূহল কাজ করছে তার। সন্ধ্যার সময় কিছু কেনাকাটার জন্য রূপগঞ্জে যাবে ভেবেছিলো, একবারে পার্সেলটা আনা যাবে।রণককে কি এখনই একটা মেসেজ করবে? না থাকুক, রাতে ঘুমানোর আগেই মেসেজ দিবে।
আজ ডায়েরির পাতায় নতুন নামটি যুক্ত করবে পেখম।রূপগঞ্জ থেকে আসার পরে ডিনারের জন্য সমস্ত রান্না একা হাতেই করেছে। ওর মা অবশ্য বলেছিলো, আমি তোকে হেল্প করি।
কিন্তু তা হবে না, আজ মাকে রান্নাঘর থেকে ছুটি দিয়েছে। পেখমের হাতের ইলিশ পোলাও ওর বাবার খুব পছন্দের। এসব ব্যস্ততার মাঝে পার্সেলটা খুলে দেখা হয়নি। ব্যস্ততা বললে ভুল হবে, চেয়েছিলো রাতে ঘুমানোর আগে দেখবে। অনেকক্ষণ নিজের কৌতূহল দমন করে রেখেছে। আর পারলো না। তাই ঘুমানোর আগে পার্সেলটা খুললো। কবিগুরুর লেখা শেষের কবিতা আর ডেইরি মিল্কের সিল্ক চকলেট। মুগ্ধতায় ওর হৃদয়টা কেঁপে উঠলো। নিজের অজান্তে চোখের কোণায় দুফোঁটা জলও এসেছিলো হয়তো।
বইয়ের ভেতরে গোঁছানো হাতের লেখায় কয়েকটি লাইন পেখমের উদ্দেশ্য, আর সাথে গোলাপের পাপড়ি।
পেখম,
আশা রাখি ভালো আছো। আমি love at first sight এ কখনও বিশ্বাসী ছিলাম না। কিন্তু সেদিন তোমার সাথে মেডিসিন ওয়ার্ডে পরিচয় হওয়ার পরে মনে হয়েছে i am in love. আমার পঁচিশ বছরের জীবনে এই অনুভূতি প্রথমবারের। তোমার অনুভূতিটা আমার জানা নেই। তবে তোমার অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি, যদি কখনও মনে হয় যে না এই মানুষটার হাতে হাত রেখে সারাটা জীবন কাটানো যায়, তাহলে সুপ্রভাত লিখে একটা মেসেজ দিও। হোক না মধ্য দুপুর কিংবা গভীর রাত। তখনই না হয় আমার জীবনের নতুন প্রভাত রচনা হবে। কোনো এক সুপ্রভাতের অপেক্ষায় রইলাম। ভালো থেকো আর ভাল রেখো ভালোবাসার মানুষগুলোকে।
৪/৭/১৯
রণক সেন।
পেখম যে রণককে পছন্দ করে, শুধু পছন্দ করে বললে ভুল হবে ভালোবাসে সেটা ও নিজেও জানে। কিন্তু কী করে জানাবে ঠিক বুঝতে পারছে না। যদিও রণক ব্যাপারটা সহজ করে দিয়েছে, তবুও কেন জানি না কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা। একবার অবশ্য ভেবেছিলো দীপার কাছ থেকে পরামর্শ নিবে। আবার ভাবে, না থাকুক দীপাকে একবারে সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে। ওর এতশত ভাবনার মধ্যে বেচারা রণককে ধন্যবাদ জানিয়ে মেসেজ দিতেও ভুলে গিয়েছে। হঠাৎ মনে হলো, রণকের জন্মদিনে যদি রণককে জানায় সেটা কেমন হবে? কিন্তু ওর জন্মদিন, তড়িঘড়ি করে রণকের প্রোফাইল দেখে পেখম অবাক, ৭ জুলাই! তার মানে আগামীকাল । তবে থাকুক আজ আর ধন্যবাদ জানিয়ে লাভ নেই। ১২ঃ০১ মিনিটেও ও উইশ করবে না, একবারে আগামীকাল সকালে সুপ্রভাত জানিয়ে জন্মদিনের উইশটা করবে।
সকাল থেকে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি পাগল মেয়েটার জন্য আজকের দিনটা একটু অন্যরকম। সকালে রণককে মেসেজ পাঠানোর পর থেকে মেসেজের রিপ্লাইএর অপেক্ষায় আছে। আসার পর থেকে ফেসবুক ডিএক্টিভেট। হোস্টেলে থাকলে অবশ্য মাঝে-মধ্যে টাইমলাইন স্ক্রল করেও সময় কাটায় পেখম। বাড়িতে এসে সেটা করে না। কখন যে অপেক্ষা করতে করতে সকাল দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে বুঝতেও পারিনি। মেঘের জন্যই এমন অবস্থা, যেন মস্ত বড়ো আকাশটা আজ অনেক নিচে নেমে এসেছে। ফুলদানিতে রাখা কদমফুল গুলো শুকিয়ে গিয়েছে দুদিন আগে। নতুন কয়েকটা নিয়ে যাবে, কিন্তু গতকাল ব্যস্ততার জন্য হয়ে উঠেনি। কোনকিছুই ভালো লাগছে না পেখমের। কফি নিয়ে ছাদে উঠলো, ভাবলো, আসার সময় কিছু ফুল নিয়ে নামা যাবে। আজকে চিত্রাকেও বিষণ্ন দেখাচ্ছে। দমকা বাতাসে আর বৃষ্টির জলে এক অন্য রূপ তার। এমনটা আগে কখনও দেখেনি পেখম।পেখমের মা পেখমকে ডাকতে এসেছে। ওর বাবা আজ আবার চপ, ছোলা এনেছে। ও মাকে বললো, তুমি নামো, আমি ফুলগুলো নিয়ে আসছি। সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে ওর মা বকা দিয়ে বললো, আর বৃষ্টিতে ভিজে ফুল তুলতে হবে না তোকে। যে কয়টা হয়েছে নিয়ে নিচে নাম তাড়াতাড়ি।
বাতাস আর বৃষ্টির তীব্রতায় কথা শুনতে অসুবিধা হচ্ছিলো মা-মেয়ে দুজনেরই। সিঁড়ির ঘরের দরজা থেকে ছাদের ওই প্রান্তের দূরত্ব বেশ খানিকটা। ওর মা একটু জোরালো কণ্ঠে বললো, শোন, তোদের মেডিকেলের রণক সেনকে চিনতিস?
বাতাসে শুনতে অসুবিধা হচ্ছে তাই পেখম আবার জিজ্ঞাসা করলো, কে?
পেখমের মা আবার বললো, রণক সেন, তোদের সিনিয়র। ছেলেটা বাইক এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে, নিউজ ২৪ এ দেখালো। তুই তাড়াতাড়ি নেমে আয়, আমি নিচেই যাচ্ছি। বাতাসের ঝাপটা আরও বেড়ে গিয়েছে।
কদমফুলগুলো পায়ে লুটিয়ে পড়েছে পেখমের। হাতের ছাতাটাও দমকা হাওয়ায় উড়ে গিয়েছে। বৃষ্টির তীব্রতা আরও বেড়েছে। খুব শখ করে গতকাল পরা পায়ের আলতা ধুয়ে রক্তের মতো বইছে। সবকিছুর মাঝে নিঃস্তব্ধ পেখম। যে ফুল ফোটার আগেই ঝরে যায় তার কি ভাষা থাকে? সে তো বাকরুদ্ধ!