শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, পৌষ ৭ ১৪৩১

লাড্ডু

সুব্রত দেবনাথ -যশোর, বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৪:০১, ১১ আগস্ট ২০২৩

লাড্ডু

ছবি- সংগৃহীত

সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে আজ। রাহেলার ঝুপড়ি ঘরের দরজার সামনা-সামনি রাস্তার অপর পাশে খালেক মিয়ার চায়ের দোকান। উনুনের অল্প আঁচে চায়ের পানি গরম হচ্ছে। বৃষ্টির জন্য দোকানে আজ খদ্দেরের আনাগোনা নেই। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে লাড্ডু। চায়ের দোকানের সামনে রাখা টেবিলে সটান হয়ে শুয়ে আছে। সাধারণত ও দোকানের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। কেউ খুশি হয়ে একটু পাউরুটি কিংবা বিস্কুট দিলে ওর দিন চলে যায় মোটামুটি। আর রাহেলা তো আছেই। রাহেলাই ওকে নিয়ে এসেছিলো এই মহল্লায়। যদিও প্রথমে কুকুর পালা নিয়ে রাহেলার স্বামী শাহিন একটু আপত্তি করেছিলো।এখন সেই বেশি যত্ন করে লাড্ডুকে। ঠিক যেন লাড্ডু ছাড়া বোঝে না কিছু। আদর করে তো মাঝে-মধ্যে লাড্ডুকে মহারাজ বলে ডাকে। আজ বোধকরি রাহেলা শাহিন কেউই কাজে যেতে পারবে না। আর একদিন কাজে যেতে না পারলে হাড়ি কড়াইতে মাকড়সা জাল বুনবে। গরিবের সংসার বলে কথা।

শাহিন এখনও শুয়ে আছে, রাহেলা বেশ আগেই উঠেছে। ঘরের টিনগুলো জরাজীর্ণ হয়ে গিয়েছে। এখন বৃষ্টি উঠানে পড়ার আগে রাহেলার ঘর ভেজে।যেখানে যেখানে পানি পড়ে সেখানে গামলা, হাড়ি পেতে দিয়েছে সে। মনে মনে ভাবে এবার বর্ষা গেলে টিনগুলো বদলাতে হবে।

গরিবের বৃষ্টি বিলাস খিচুড়িতেই আটকে থাকে ইলিশ নিয়ে আর জাতে উঠতে পারে না। তাই বুঝি রাহেলা আটাশ ধানের চাউল দিয়ে বেশ ঝুরঝুরে খিচুড়ি রান্না করেছে। আর একটা ডিমে বেশি পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে ভেজে দুই টুকরা করেছে। একটু মরিচ ভর্তা করবে ভাবছিলো। শাহিনের হাকডাকে ভাবনায় ছেদ পড়ে তার। যায় বলে শোবার ঘরে আসে। শোবার ঘর বলতে ঝুপড়ির মাঝে দুইটা টিন দিয়ে পার্টিশন করে এক পাশে রান্না করে আর বাকিটা শোবার ঘর।

শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রাহেলা জিজ্ঞাসা করে, কী কবা কও?
-আরে কবো বলেই তো ডাকিছি, বস এখানে।
-আমার মেলা কাজ আছে, তোমার সাথে পিরিত করলে চলবে না।
এতক্ষণ শাহিন শুয়ে ছিল। এবার উঠে রাহেলার হাত ধরে টান দিয়ে পাশে বসায়। আদুরে গলায় বলে, দেখছিস কেমন পানি হচ্ছে, চল্ বেডটি খাই দুইজনে, সিরিয়ালে যেমনডা খায়।
কথাগুলো বলে একগাল হাসে শাহিন।

রাহেলা শাহিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, আর খেতে হবে না তোমার বেডটি, চা ফুরোয় গিয়েছে, চিনি নেই।হাতমুখ ধুয়ে নাও। খিচুড়ি রান্দিছি, গরম গরম খেয়ে নিও। তোমার জন্য তোমার পছন্দের মরিচ ভর্তাও বানাবো।
শাহিনের চোখে আনন্দের ঝলকানি। এত বছর খিচুড়ি রান্না হয়েছে আর মরিচ ভর্তা হয়নি এমন কখনও দেখেনি সে। অভাবের সংসারে ভালোবাসাই বুঝি পুতুলনাচের সুতা।

দরজার পাশে যে গামলাটা রেখেছিলো সেটা বৃষ্টির পানিতে ভরে গিয়েছে। পানি পরিষ্কার করে আবার রান্না ঘরে যায় রাহেলা।

বৃষ্টিটা একটু কমেছিলো মাঝে, আবার হঠাৎ করে বেড়েছে। শাহিন দাঁত ব্রাশ করতে করতে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। লাড্ডু তখনও বেঞ্চের উপর শুয়ে আছে। শাহিন লাড্ডুকে আয় আয়... বলে ডাক দিলে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে লাড্ডু। কিন্তু বৃষ্টির জন্য আসে না।শাহিন টিন থেকে যে বৃষ্টির পানি পড়ছে সেটা দিয়েই হাত-মুখ ধুয়ে নিলো।

গতবছর এমন এক বৃষ্টির দিনে সে কি কাণ্ড। রাত তখন বারোটার মতো। মহল্লা শুনসান, লাড্ডু সজোরে ঘেউ ঘেউ করছে। শেষমেষ শাহিন দরজা খুলে রীতিমত চমকে উঠে। দরজা থেকে সামান্য দূরে একটা কেউটে সাপ ফণা তুলে আছে, আর লাড্ডু তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ঘেউঘেউ করে ডাকছে। পরে মহল্লার লোক এসে সাপটাকে মারে। সে যাত্রায় লাড্ডুর জন্য বড়ো বাঁচা বেঁচেছিলো রাহেলা-শাহিন।

বিছানার উপর গামছা বিছায়ে খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা করছে রাহেলা। আগে থেকেই লাড্ডুর জন্য একটা মাটির মালসাতে অল্প পরিমাণে খিচুড়ি আর ভাজা ডিমের একটা অংশ তুলে রেখেছিলো সে। শাহিন ঘরে ঢুকতেই রাহেলা বলে, আজ আর লাড্ডুর কেক, পাউরুটি জুটবে না, দোকানে মানুষ নেই। যাও খাবারডা দিয়ে আসো ওরে।
কিন্তু লাড্ডু তার আগেই হাজির দরজার গোড়ায়। খুব ভদ্র স্বভাবের, কখনো ঘরে ঢোকে না। ঝুপড়ির পাশে শাহিনের যে ভ্যান রাখা থাকে রাতে তার উপর ঘুমায়।শীতের দিনে হয় রাহেলা, না হলে শাহিন পুরনো একটা কাঁথা দেয় ওর গায়ে।
রাহেলার প্লেটে ডিম না দেখে শাহিন জিজ্ঞাসা করে, রাহেলা, প্লেটে ডিম নেই কেন?
রাহেলা প্লেটের খিচুড়ি নাড়াচাড়া করতে করতে জানায়, খেতে ইচ্ছা করছে না।
-খাবি না ক্যান? শরীল খারাপ?
-না সকাল থেকে কেমন বমি, বমি লাগছে!
-তোরে বলি বেশি ভাজা খাস না,শুনিস না তুই আমার কথা। গ্যাস হইছে বোঝ এখন।
"আইছে আমার ডাক্তার" বলে বিষয়টা এড়িয়ে যায় রাহেলা। মাঝে-মধ্যে সে অনেক বেশি অবাক হয় এই মানুষটাকে দেখে। নিজের বাবাকে ওর মায়ের জন্য এমনটা উতলা হতে কখনও দেখেনি সে।

টুনিবুড়ির হাকডাকে ভাবনায় ছেদ পড়ল রাহেলার।উচ্চতা কম হওয়াতে মহল্লার সবাই তাকে টুনিবুড়ি বলে ডাকে। আর টুনিবুড়ি রাহেলাকে ডাকে রাঙ্গাবউ।খাবারের প্লেটটা সরিয়ে দরজার কাছে এসে টুনিবুড়িকে ভেতরে আসতে বলে।
-নারে রাঙ্গাবউ ভেতরে আসবো না।
-আরে আসো তো টুনিখালা,খাইছো সকালে? মরিচভর্তা দিয়ে দুইটা খিচুড়ি খাও।
-নারে রাঙ্গাবউ, আমি খেয়ে আয়ছি, ফাতেমার হলুদ দিবে, যাবি না?
-না, খালা। এই কাদাপানির মধ্যে আর যাতি ইচ্ছা করছে না। তুমি এই বৃষ্টির মধ্যে বের হলে ক্যান?
-কী করব ক? ফাতেমার মা মেলাবার কইছে। না গেলি কী না কী ভাবে।
-তুমি তালি যাও, খালা। আমার আবার মেলা কাজ। আজ সকালে কাজে যাতি পারলাম না তো। ভাবছি কাথায় কয়ডা ফোঁড় দেবো।
-যায়রে রাঙ্গাবউ

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রাহেলা। আজ হয়তো চোখ টানাটানি থেকে রেহাই পেলো সে। না হলে বন্ধ্যাত্বের জন্য কিছু না কিছু ভোগান্তি পোহাতে হতো। দুপুরের পর থেকে বৃষ্টির সাথে দমকা বাতাস বয়ে চলছে।অনেকদিন পরে ভাতঘুমের সুযোগ মিলেছে দুজনের। গত দুই একদিন ধরে রাহেলা কিছু বলবে বলবে করেও বলে উঠতে পারছে না। তবুও সংকোচ কাটিয়ে বলে ফেললো, আমার না গতমাসে মাসিক হয়নি, এই মাসেরটাও!
-এই মাসেরটাও হইনি?
-না, বুঝতে পারছি না। আমার তো আবার উল্টাপাল্টা হয়, তা হোক।
-টেস্ট করাবি?
-ভয় লাগে গো, এভাবে তোমারে কষ্ট দিতি ভালো লাগে না।
-ধুর কষ্টের কী আছে? আমি বিকালে মোড় থেকে টেস্টের জিনিস আনবানি। টেস্ট করিস আর আল্লাহ, আল্লাহ করিস।

রাহেলা শোনে কিন্তু আর কিছু বলতে পারে না। মুগ্ধতায় অবসান ঘটে ওদের বাক্যালাপের।

আজ বেশ রোদ উঠেছে। শাহিন ভোরেই ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। রাহেলাও কাজে বের হবে সেজন্য দুপুরের রান্না সেরে রাখছে। সচরাচর রাহেলা মোড়ের মাথা দিয়ে কাজে যায় না। আজ আবার বাড়িওয়ালীর জন্য মেহেদি পাতা নিয়ে যেতে হবে। অগত্যা কী আর করার। মোড়ের কিছুটা দূরে থাকতে রাহেলার চোখ আটকে যায় ডাস্টবিনের পাশে। রাহেলা ঠিকই অনুমান করেছিলো। লাড্ডু নিথর হয়ে পড়ে আছে। মুখের পাশ থেকে রক্ত ক্ষরণ হয়ে জমাট বেঁধে আছে। চিৎকার দিয়ে ওঠে রাহেলা। কান্না আর চিৎকারে এতক্ষণে বেশকিছু মানুষও জমা হয়েছে তার পাশে। লাড্ডুর জিহ্বা বেশখানিক বেরিয়ে আছে আর তাতে বিঁধে আছে একটা ব্লেড। পাশ থেকে একজন বলে ওঠে, ডাস্টবিন থেকে খাবার খেতে গিয়েই বোধ হয় ব্লেডটা মুখে বিঁধেছে।

সকাল থেকে রাহেলা অনেক বেশি উতলা হয়ে আছে কখন সে শাহিনকে নতুন অতিথি আসার খবর জানাবে। আর তার মাঝেই এসব, চোখের জলে ঝাপসা হয়ে আসে রাহেলার পৃথিবী। একটা ভুল, একটা মৃত্যু আর কিছুটা একাকিত্ব আজ এই শহরে অভ্যাস।