ছবি- সংগৃহীত
তখন রাত আড়াই টা। একটা কোনে বিয়ে বাড়িতে বিদায়ের সুর ভাসছে। মাঙ্গলিক কর্ম বলতে বিয়ে বাড়ির যা কিছু বোঝায়, জামাই বরণ, বিয়ের মন্ডপে বর কনেকে পাশাপাশি বসিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ, কন্যা দান, আত্মীয় স্বজনদের থেকে আশীর্বাদ, দান। তারপর কনেকে নিয়ে কনের বোনদের দরজায় খিল দেয়া। বরের কাছে টাকা নিয়ে তবে দরজা খুলে দেয়া, সবকিছু প্রায় শেষ। এখন কনে বিদায়ের পালা।
তুমি কনের বান্ধবী, তোমার নাম আমি জানি। কিন্তু আমি তোমাকে তোমার নামে ডাকি না। তোমাকে আমি নিরু বলি। কেন বলি, তা আমিও জানি না। আর তুমিও কখনো জানতে চাও নি। তোমার সাথে আমার পরিচয় আরো তিন বছর আগে। এক বসন্তের বিকেলে। তখন স্কুল ছুটির সময়। তুমি আর তোমার আরো বেশ কয়েকজন বান্ধবী মিলে তোমরা আমাদের বাড়িতে যাচ্ছো। আজকের কনে আমার আত্মীয়া। আত্মীয়ার বান্ধবী তুমি। সেই সূত্রে পরিচয়। না, সেই পরিচয়ে আশ্চর্য কোনো ঘটনা ঘটে নি। শুধু আমি একজোড়া মায়াবী, টানা টানা চোখের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। আমিও যেমন জানতাম, সেরকম তুমিও জানতে, ঐ মায়াবী চোখ জোড়া তোমার।
তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। পরিচয় আরো ভালোভাবে হয়েছে। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হতো। বসন্তের পর বসন্ত পার হয়েছ ।আমি প্রথম দেখায় যেমন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম, এখনও সেরকমই তাকিয়ে থাকি। তুমি ধীরে ধীরে নিরু হয়ে গেছ। আজ এই বিয়ে বাড়িতে তুমি আর আমি পাশাপাশি বসে আছি। তোমার বান্ধবীর বিয়ে হয়ে গেল, আর কিছু সময় বাদে বিদায় হবে। তুমি আমাকে বললে, তুমি বাড়ি যাবে। তোমাকে এগিয়ে দিতে হবে।
আমি বলেছিলাম, এত রাতে। এখন তো রাত প্রায় আড়াইটা। কি করে সম্ভব?
কিন্তু তোমাকে যেতে হবে। তোমার হাতে অনেক কাজ। রাতের এইটুকু সময় তোমাকে ঘুমাতেই হবে। না হলে চলবে না।
আমি বললাম, তোমাদের এদিকের সবকিছু আমি ঠিক জানি না। শেয়াল ধরবে নাতো।
নিরু হেসে বলল, আপনি শেয়াল ভয় পান?
হুম, অনেক ভয় পাই। কেন তোমার ভয় লাগে না?
নিরু হাসছে। এই উজ্জ্বল আলোতে তার হাসি দেখছি আমি। আর হারিয়ে যাচ্ছি যেন ভাবনা জগতে। এত সুন্দর কি করে হাসতে পারে নিরু?
নিরু বলল, কি ভাবছেন। আমি তো আছি। শেয়াল আসবে না।
তাই বললে কি হয়, পাকা রোড ধরে যেতে হবে আমাদের, মাতাল ঘুরবে না? যদি ওরা আমাদের ধরে। তাহলে কি শেয়াল ধরার থেকে কম হবে মনে করেছ।
নিরু বলে, তেমন কিছুই হবে না। চলেন।
বিয়ে বাড়ি থেকে বের হলাম। নিরু আর আমি। ও সামনে, আমি পিছনে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আলো থেকে অন্ধকারের দিকে হাঁটছি। বিয়ে যে পাড়ায়, সেই পাড়া থেকে বেরিয়ে একটা বড় রাস্তায় এলাম আমরা। এই রাস্তা ধরে এক কিলোমিটার এগোলে নিরুদের বাড়ি। নিরুর মতো আকর্ষণীয় চেহারার একটা মেয়ের সাথে এত রাতে হাঁটছি, কই তেমন কিছু মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, আমাদের এই পথ যেন খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে নিরু বলল, এত রাতে আমাকে এগিয়ে দিচ্ছেন। মনে কোনো কিছু আবার নেই তো?
আমি বললাম, মনে কিছু থাক বা না থাক, মন তো কিছু চাইতে পারে।
নিরু গলা নামিয়ে বলে, এই আপনার মনের বাসনা। দুষ্টামি করবেন না কিন্তু।
আরে না৷ তোমার সাথে দুষ্টুমি করতে পারি। বলে হাত এগিয়ে দিলাম তার দিকে। সে আমার হাতটা ধরে বলল, এই ছুঁয়ে দিলাম আপনাকে। এই চাঁদনি রাতের নির্জনতাকে সাক্ষী রেখে বলছি, এ জীবনে আর কারো সাথে রাত আড়াই টার সময় কোথাও যাবো না। যাওয়া হবে না। জোসনার মুগ্ধ আলোতে পথঘাট মোহময় লাগছে। আমরা একে অপরের প্রতি মোহিত। হঠাৎ একটা পেঁচা ডেকে উঠলো পাশের একটা গাছে। নিরু ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। আমিও তাকে আঁকড়ে ধরলাম, বললাম, এই তোমার সাহস। নিরু বলল, এখন কোনো কথা নয়, বলে তার তপ্ত ঠোঁট আমার ঠোঁটের উপর ছুঁয়ে দিল। এরপর আমি যেন বোধ শক্তি হারিয়ে ফেললাম। মনে হলো, এটা কোনো বাস্তবতা নয়। এটা স্বপ্ন। তবে স্বপ্নভঙ্গ হতে বেশি দেরি হলো না। নিরুর সালোয়ারের ফিতার ওপরে রাখা আমার হাত চেপে ধরে নিরু যখন বলল, প্লিজ, এর বেশি আমাকে জানতে চেয়ো না।
এ আমি কি করতে যাচ্ছিলাম। নিজেকে নিরুর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করলাম। তখন রাত কটা জানি না, ঘড়ি দেখার মতো ইচ্ছে নেই। আবার দুজনে হাঁটছি। এই পথ যেন এখন শেষ হতেই চায় না।