ছবি- সংগৃহীত
জায়গাটার নাম তিনপাড়া। গ্রীষ্মের এক তপ্ত দুপুর। একটা জনহীন রাস্তা। রাস্তাটায় কোন গাছ নেই। একজন পাগল ওই তপ্ত দুপুরে মোটা পুলওভার গায়ে চাপিয়ে নগ্ন পায়ে রাস্তাটা দিয়ে ছুটছে আর ক্রমাগত চেঁচাচ্ছে, ‘সমাধান…সমাধান না হলে নিস্তার নেই।’
খানিক ছোটার পর হঠাৎ দুহাতে নিজের গলাটা চেপে ধরে আরো জোরে চেঁচিয়ে বলল, ‘সমাধান..সমাধান না হলে নিস্তার নেই।’
ইন্সপেক্টর ঘোষাল লাশটাকে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে বলেন, ‘ক্রাইম সিনে প্রথম কে এসেছিল?’
নিলয় সাহা প্রমোশন পেয়ে এই দুমাস হল কন্সটেবল থেকে সাব ইন্সপেক্টর হয়েছেন। এতদিন পর্যন্ত ছিঁচকে চোর, জায়গা জমি নিয়ে ঝগড়া বা সাধারণ মারামারির কেস সামলিয়েছেন। এইসব লাশ/টাশ নিয়ে কাজ করেন নি কখনও। প্রমোশন পেয়েই এইরকম একটা কেস দেখে রীতিমতো জবুথবু হয়ে গেছেন। তাই লাশ দেখার প্রথম ধাক্কাটা সামলে উঠতে গিয়ে ইন্সপেক্টর ঘোষালের কথাটা তার কানঅব্দি পৌঁছায় নি।
নিলয়কে ওরকম হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঘোষাল খানিক গর্জে উঠে বলেন, ‘তোমার মনটা কোনদিকে নিলয়? কাজে মন না থাকলে ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে থাকো।’এই আচমকা ঝড়ের জন্য তৈরি ছিলেন না নিলয়। ধমক শুনে কাঁচুমাচু মুখ করে নিলয় বলে, ‘স…সরি স্যার। কী বলছিলেন স্যার!’
ইন্সেপেক্টর ঘোষাল আবার বলেন, ‘ক্রাইম সিন মানে লাশটাকে সবার আগে কে দেখতে পায়?’
নিলয় তখন বলে, ‘ওই হরেকমাল ঠ্যালাওয়ালা লাশটাকে দেখতে পায়।’
ইন্সপেক্টর ঘোষাল একটু গম্ভীর হয়ে বলেন, ‘ডাকো তাকে।’
নিলয় মাথা নাড়িয়ে ঠ্যালাওয়ালা মুকুলকে ডেকে আনে।
মুকুলকে দেখে নিলয় বলে, 'তুমি কখন লাশটাকে দেখলে?'
মুকুল একটু ভেবে বলে, 'ওই ধরুন বিকেল চারটে সাড়ে চারটে হবে। আমি আমার বিক্রি শেষ করে বাড়ি ফিরছিলাম। তখনই দেখি ওই মনু পাগলা রাস্তার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে।'
ইন্সপেক্টর ঘোষাল মুকুলকে মাঝপথেই থামিয়ে বলেন, 'তার মানে তুমি মৃতব্যক্তিকে চিনতে?'
মুকুল বলে, 'হ্যাঁ চিনতাম তো! সারাদিন তো ওই বড়রাস্তায় যেখানে আমার ঠ্যালা নিয়ে বসি সেখানেই তো সারাক্ষণ ঘুরঘুর করে বেরাতো। মাঝেসাজে আমি খেতে দিতাম।'
ইন্সপেক্টর ঘোষাল একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, 'আচ্ছা…তারপর!'
একটা ছোট ঢোক গিলে মুকুল আবার বলতে শুরু করে, 'একটু কাছে এগুতেই দেখি সে দুহাত দিয়ে নিজের গলা টিপে ধরে আছে। ভাবলাম পাগল মানুষ, কী মাথায় এসেছে কে জানে! কাছে গিয়ে এক দুবার ডাকলাম। সাড়া পেলাম না। তারপর একটু ঝুঁকে ভাল করে তাকাতেই বুঝতে পারি যে তার বুক ওঠানামা করছে না। তখন আমি পুলিশে খবর দেই।'
এতক্ষণ সব শুনে নিলয় মুকুলকে বলে, 'তা হঠাৎ পাগল মরেছে বলে পুলিশে খবর দিতে গেলি কেন? এ তো পাগল! এর মারা যাওয়া না যাওয়ায় কী যায় আসে।'
মুকুল হাত কচলে বলে, 'অপরাধ নেবেন না স্যার। ও পাগল হলেও তো মানুষ বলুন! তাছাড়া সকালেও যাকে জ্যান্ত দেখলাম সে দুপুর গড়াতে না গড়াতেই মারা গেল! তাই..।'
মুকুলের কথা শুনে ইন্সপেক্টর ঘোষাল বলেন, 'তাছাড়া যে যতই পাগল হোক। কোন পাগলই নিজেই নিজের গলা টিপে আত্মহত্যা করবে না। রাস্তার পাগলদের দেখো না, সামান্য একটু তাড়া খেলেই কেমন প্রাণভয়ে পালিয়ে যায়। সেখানে এ তো নিজেকে…ব্যাপারটা ঠিক ততটাও স্বাভাবিক নয়। তুমি বডি পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠাও। আর ফরেনসিক টিমকে ডাকো।'
নিলয় সাততাড়াতাড়ি ফরেনসিক টিমকে ডাকে। ফরেনসিক টিম এসে সব এভিডেন্স সংগ্রহ করার পর লাশ পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠিয়ে দেয় নিলয়। নিলয় এখনও নিজেকে ঠিক ইন্সপেক্টর ভাবতে পারে না। এখনও তারমধ্যে সেই কন্সটেবল মার্কা অ্যাটিচুডই রয়ে গেছে। সারাদিন রোদে খেটেখুটে শরীরটা বড় ক্লান্ত লাগে নিলয়ের। বডি পোস্টমর্টেমে পাঠিয়ে নিলয় সোজা বাড়ি আসে। বিয়ে থা করে নি নিলয়। একাই থাকে। মাঝেসাঝে মা আসেন। কিছুদিন থাকেন আবার চলে যান। তার আবার শ্বশুরভিটের বড় টান!
বাড়ি ফিরে গায়ে খলখলিয়ে জল ঢালার পর কিছুটা শান্তি লাগে নিলয়ের। বিছানায় এলিয়ে শুয়ে সবে ঘুমের ঘোরটা লেগেছে ঠিক তখনই মোবাইলের খিটখিটে আওয়াজটা নিলয়ের অত সুন্দর ঘুমের ভাবটাকে পুরো ভাবহীন করে দিলো। একটা বিরক্তিকর শব্দ করে চোখ বন্ধ অবস্থায় মোবাইলের দিকে হাত বাড়িয়ে নিলয় মনে মনে বলে, ‘যাতে স্যারের কল না হোক।’
কিন্তু নিলয় চোখ খুলে দেখতে পায় স্ক্রিনে ফুটে উঠেছে, “ইন্সপেক্টর ঘোষাল কলিং”।
'উফফ! মনে হচ্ছে নিজের মাথাটাই দেওয়ালে ঠুকে দেই', মনে মনে বলে নিলয়।
কিন্তু মনের যাবতীয় বিরক্তি মনেই চেপে রেখে নিলয় ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশের গা জ্বালানো স্বরে ইন্সপেক্টর ঘোষাল বলেন, 'কী বিছানায় শুয়ে পড়েছো নিশ্চয়ই!'
'উফফফ! এ কি সবজান্তা হনু না কি', নিলয়ের বিরক্তি উগরে উগরে বেরোচ্ছে। কিন্তু মুখে নমনীয়তা বজায় রেখে বলে, 'ওই মানে স্যার..আজ তো মারাত্মক গরম ছিল। রোদে অতক্ষণ দাঁড়িয়ে..।'
'ভুলে যেও না নিলয় তুমি কিন্তু এখন আর কনস্টেবল নও। একজন ইন্সপেক্টর। একজন সাব ইন্সপেক্টর যার দায়িত্ব কিন্তু অনেক বেশি। এইভাবে সামান্য একটু রোদে কাজ করতেই যদি হাঁপিয়ে পড়ো তাহলে তো মুশকিল', ইন্সপেক্টর ঘোষাল নিলয়কে মাঝপথেই থামিয়ে একনাগাড়ে নিজে বলে থামলেন।
একটু পরেই আবার বললেন, 'চটপট তৈরি হয়ে গাছপুকুরের সামনে এসো।'
এতক্ষণ এতগুলো জ্ঞানবাণী শুনে নিলয় একটু ভেবলে গিয়েছিল। এখন আবার তৈরি হতে হবে শুনে বোকার মতো বলেই বসল, 'গাছপুকুর…সে তো পূর্বদিকের রেললাইন পেরিয়ে। এতদূর কেন যেতে হবে স্যার।'
ইন্সপেক্টর ঘোষাল এবার খানিক গর্জে উঠে বলেন, 'আমাদের জন্য উপহার রাখা আছে। তাড়াতাড়ি পৌঁছাও সেখানে। আমি প্রায় পৌঁছে গেছি। আজব মানুষ একটা!'বলেই লাইনটা কেটে দিলেন ইন্সপেক্টর ঘোষাল। নিলয়ের চোখ থেকে আমেজেরা সব খসে পড়েছে। বিছানা ছেড়ে মনক্ষুণ্ণ হয়ে বিরবির করে বলে, 'ধ্যাৎ! কী কুক্ষণে যে প্রমোশনটা নিয়েছিলাম।'
কোনরকমে তৈরি হয়ে গাড়িটাকে ঘোড়ার মতো ছুটিয়ে নিলয় গাছপুকুরের সামনে পৌঁছায়। আসার পথে নিলয়ের কী মনে হতে ফরেনসিক টিমকে একটা খবর দিয়ে দিয়েছিল। নিলয় ঘটনাস্থলে পৌঁছিয়ে দেখে ইন্সপেক্টর ঘোষাল দাঁড়িয়ে আছেন দুজন কনস্টেবলকে নিয়ে। আরো কিছু লোকাল মানুষও আছেন। হয়তো তারই অপেক্ষায়! গাড়ি থেকে নেমে নিলয় ইন্সপেক্টর ঘোষালের সামনে দাঁড়াতেই দেখে একজন ভিখারী ওখানে মরে পড়ে আছে। দুপুরের সেই পাগলটার মতোই দুহাত দিয়ে নিজের গলা টিপে ধরে আছে। চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। বডি ভাল করে পর্যবেক্ষণ করেও শরীরে কোন ধস্তাধস্তি বা ফোর্স অ্যাটাকের সামান্য চিহ্নমাত্র নেই। ইন্সপেক্টর ঘোষাল মৃতদেহের আশেপাশের জায়গাটা ভাল করে পর্যবেক্ষণ করছেন। ইতিমধ্যে জায়গাটার চারদিক ঘিরে ভীড় জমতে শুরু হয়ে গেছে। কনস্টেবল দুজন ভীড় জমার আগেই বেড়িগেট টেপ দিয়ে জায়গাটাকে ঘেড়াও করে দিয়েছে। এমন একটা দৃশ্য দেখে উপস্থিত সকলের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জনতার ভীড়ের মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হয়েছে। নিলয় ভীড়টার কাছে গিয়ে ঘাড়টা উঁচু করে একটু জোরে বলে ওঠে, 'আপনাদের মধ্যে কী একে কেউ চিনতো?'
ভীড়ের মধ্যে গুঞ্জনটা এবার আরেকটু চড়া হয়। সবাই একে অপরের দিকে তাকায়। তারপর মাথা নাড়তে থাকে। নিলয় আবার ভীড়কে উদ্দশ্য করে একই কথা বলে। কিন্তু কোন উত্তর আসে না। নিলয় ভাবে হয়তো মৃতব্যক্তিকে কেউ চেনে না। এই ভেবে নিলয় যেমাত্র পেছন ফিরতে যাবে ঠিক সেসময় ভীড় থেকেই কেউ একজন বলে উঠল, 'আমি চিনি একে।'
চট করে নিলয় পেছন ফিরে দেখে একজন সাতাশ আঠাশ বছরের ছেলে ভীড়ের মাঝখানে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। নিলয় ভীড়ের দিকে এগিয়ে আসতেই ছেলেটি বলে, 'ও তো খড়িকাকা। এই তো ওই ওদিকের কোনাটায় বসে ভিক্ষে করতো।'
নিলয় একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, 'তুমি কি করে চিনলে একে?'
ছেলেটি বলে, 'আমি তো কর্পোরেশনে কাজ করি। এই রাস্তা-টাস্তা পরিষ্কার করার কাজ করি। রোজই তো দেখতাম যে খড়িকাকা ওখানে হয় ঘুমিয়ে আছে নয় তো ভিক্ষে করার বাটিটা নিয়ে বসে আছে। কখনও সখনও খড়িকাকা কিছুই ভিক্ষেতে পেত না তখন আমি কিছু টাকা বা খাবার দিতাম তাকে। কারোর সাতেপাঁচে থাকতো না। দুদিন খড়িকাকাকে এখানে দেখতে পাই নি। ভাবলাম যে হয়তো ভিক্ষে করতে অন্যত্র গিয়ে বসেছে। এরকম একটা নির্ঝঞ্ঝাট মানুষের এইরকম মৃত্যু ভাবা যায় না।'
নিলয় বলে, 'তা এই খড়িকাকার বাড়ি কোথায়?'
ছেলেটি একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, 'ভিখারীদের কী কোন বাড়ি থাকে স্যার? এখানেই রাতে চাটাই পেতে ঘুমিয়ে পড়তো। আর বৃষ্টি হলে ওই গাছতলায় আশ্রয় নিত।'
নিলয় একটু থেমে বলে, 'তুমিই কী একে প্রথম দেখেছো?'
ছেলেটি বলে, 'না আমি দেখি নি। আমি তো খবর শুনে আসলাম।'
নিলয় একটু বিরক্ত হয়েই বলে, 'ওও বুঝলাম।'
ভীড়কে উদ্দেশ্য করে নিলয় আবার জিজ্ঞেস করে, 'লাশটাকে প্রথমে কে দেখেছেন?'কিন্তু কোন জবাব আসে না। কোন উত্তর না পেয়ে নিলয় লাশটার দিকে মনোনিবেশ করে। ফরেনসিক টিমের লোকজন যতটা সম্ভব ঘটনাস্থল থেকে স্পেসিমেন্ট কালেক্ট করে নিচ্ছে।
নিলয় ঘোষালকে গিয়ে বলে, 'স্যার মৃতের নাম খড়ি। এই রাস্তাটাতে বসে ভিক্ষে করে সে। কিন্তু স্যার একটা প্রশ্ন মনে আসছে।'
ইন্সপেক্টর ঘোষাল বলেন, 'বলো কী প্রশ্ন?'
নিলয় বলে, 'স্যার আগের লোকটার বডি আমরা তাড়াতাড়ি পেয়ে গেছি। কিন্তু এই লোকটার বডিটা পেতে এত দেরি কেন হল? যদিও এর মৃত্যু আগে হয়েছে।'
ঘোষাল সামান্য হেসে বলেন, 'আজ ছুটি ছিল। আর এই জায়গাটা তিনপাড়ার লোকবহুল এলাকার বাইরে। তাই হয়তো চট করে করে নজরে আসে নি।'
উত্তরটা নিলয়ের ঠিক মনঃপুত হল না। সে তখন ফরেনসিক টিমের একজনকে উদ্দেশ্য করে বলে, 'কী মনে হয় ডঃ রায় মৃত্যুটা ঠিক কখন হয়েছে?'
ডঃ রায় কপালটা একটু কুচকে বলেন, 'এই ধরুন রাত সাড়ে বারোটা থেকে দেড়টার মধ্যে। আগের ভিক্টিমটার মৃত্যু ঠিক বারো আগে এর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু দুটো মৃত্যুর ধরন প্রায় একই।'
ইন্সপেক্টর ঘোষাল বলেন, 'কিন্তু আপনি এত শিওর হলেন কী করে?
ডঃ রায় বলেন, 'দেখুন বডিটা দেখেই মনে হচ্ছে যে রিগর মর্টিসের প্রসেস শেষ হয়ে গেছে। বডি রিল্যাক্স হয়ে গেছে। রিগর মর্টেসের সম্পূর্ণ প্রসেস শেষ হতে চব্বিশ ঘন্টা সময় লাগে। এখন বাজে বিকেল পাঁচটা। আর ভাল করে লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবেন যে বডির ব্লাড ভেসেলগুলোর রঙ পরিবর্তন হয়েছে। বডিরও রঙ পরিবর্তন হয়ে সবজে হয়ে গেছে। এটা তখন হয় তখন রিগর মর্টেসের প্রসেস শেষ হয়ে বডি পচতে শুরু করে। আগের বডিটায় রিগর মর্টেসের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়েছিল। মানে পাগল ব্যক্তিটির মৃত্যু প্রায় দুপুর দুটো আড়াইটের মধ্যে হয়েছে। আপনারা লাশটাকে দেখেছেন বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ। আপাত পর্যবেক্ষণে এইটুকু তথ্য আপনাকে দিতে পারি। কিন্তু..।'
নিলয় সামান্য উত্তেজিত হয়ে বলে, 'কিন্তু কী ডক্টর রায়?'
ডঃ রায় একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলেন, 'এই মৃত্যুগুলোকে ঠিক খুন বলা যাবে কিনা তা এখনই বলা সম্ভব নয়। আরেকটু পরীক্ষা করতে হবে।'
'তাহলে তাড়াতাড়ি করুন ডঃ রায়', পেছন থেকে গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে ইন্সপেক্টর ঘোষাল। এলাকায় একের পর এক মৃত্যু হচ্ছে। মৃত্যুর ধরনটাও একই রকমের। কিন্তু মৃত্যুর কারণটা কী? তাছাড়া এগুলো সত্যিই কী হত্যা না কি আত্মহত্যা?'
এরপর ফিসফিসিয়ে ইন্সপেক্টর ঘোষাল নিলয়ের কানের কাছে এসে বলে, 'এই মানুষটা কিন্তু পাগল নয়। এর মৃত্যুটা আপনার কাছে ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে তো!'
নিলয়ের ইন্সপেক্টর ঘোষালের কথায় প্রচণ্ড অসন্তোষ হয়। ইন্সপেক্টর ঘোষাল তাকে দু'পয়সারও পাত্তা দেয় না। যেন শুধু একসাথে কাজ করতে হবে বলে করছে। নাহলে ওনার ক্ষমতায় থাকলে কবেই এই কেস থেকে নিলয়কে সরিয়ে দিত। ফরেনসিক টিম লাশটা উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। নিলয়ও থানার দিকে রওনা দেয়।
তিনপাড়া এলাকাটা বেশ জনবহুল না হলেও এখানের জনসংখ্যা নেহাৎ কম নয়। তবুও এতদিন ধরে কখনও এখানে চুরি ডাকাতি ছাড়া এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের কথা শোনা যায় নি। পরপর এমন দুটো অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর শুনে এলাকায় বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
রাত দশটা বাজে। নিলয় এবার বাড়ি যাবে বলে ফাইল গুছিয়ে একসাইডে করে রাখছিল। হঠাৎ একটা ফাইলের নিচ থেকে একটা ভাঁজ করে প্যামফ্লেট বেরোয়। দোমড়ানো মোচরানো একটা রঙবেরঙের প্যামপ্লেট। প্যামফ্লেটটা দেখেই ওই ছেলেটার কথা মনে পড়ে গেল। মাথা ভর্তি বড় বড় চুল, চোখদুটো অসম্ভব চঞ্চল। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়িঁ। তবে ছেলেটার মধ্যে একটা অদ্ভুত জিনিস ছিল। থানায় আসার পথে একটা সিগন্যালে ছেলেটাকে দেখতে পেয়েছিল নিলয়। অদ্ভুতভাবে হেঁটে তার দিকে এসে হাতে কাগজটা ধরিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল সে। কিন্তু কিছুতেই বলে উঠতে পারছিল না। না, ছেলেটি তোতলা ছিল না। অনেকসময় হয় না যে আমরা অনেকগুলো কথা বলতে চাইছি কিন্তু ঠিক করে কিছুই বলতে পারছি না। সবগুলো কথা কেমন যেন আঠার মতো একটা আরেকটার সাথে সেঁটে আছে। সবগুলো কথা যেন একসাথে মুখ থেকে বেরোতে চাইছে। অথচ একবর্ণও পরিষ্কার ভাবে মুখ থেকে বেরোতে পারছে না। ছেলেটির অবস্থাও ঠিক সেইরকম ছিল। একটুপরেই সিগন্যাল গ্রিন হয়ে যাওয়ায় নিলয় বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে আসে। কিন্তু ছেলেটির দেওয়া প্যামফ্লেটটা আর ফেলা হয় না তার। এখন ফাইল গোছাতে গিয়ে ওটা দেখতে পেয়ে মুচরিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেয় সে। ডাস্টবিনটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে নিলয় ভাবে, 'সেদিন ওই ছেলেটা কে ছিল? কী-ই বা বলতে চাইছিল সে?'
কী হল বাড়ি যাবে না? নাইট শিফ্ট তো শুরু হয়ে গিয়েছে।
কানের কাছে হঠাৎ ইন্সপেক্টর ঘোষালের জলদ গম্ভীর কন্ঠস্বরটা আসতেই নিলয় সামান্য ঘাবড়ে গেলেও মুখে হালকা হাসি টেনে বলে, 'এই তো স্যার বেরোবো। মৈনাককে সব বুঝিয়ে দিয়েছি। আপনিও তো বাড়ি যাবেন!'
'নাহ্! আমি আরো খানিকক্ষণ থাকবো। তুমি বেরিয়ে যাও,' ইন্সপেক্টর ঘোষাল বলে।
থানা থেকে বেরিয়ে নিলয় মনে মনে ভাবে, 'লোকটার কী বাড়িঘর নেই নাকি! সারা দিনরাত থানাতেই পড়ে থাকে। তা বিছানাপত্তর নিয়ে থানাতেই থেকে গেলে পারে..আমার জ্বালা খানিক কমবে।'কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করে নিলয় বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
ওদিকে ঘোষাল কিছু পুরোনো ফাইল নিয়ে ঘাটতে থাকে। তিনি এই তিনপাড়ার থানাতে সুপারিটেন্ডেন্ট পদে নিযুক্ত হয়ে এসেছেন চারমাস হল। এমনিতে জায়গাটা শান্তশিষ্টই ছিল। কিন্তু এই শান্তশিষ্ট জায়গাটা হঠাৎই ল্যাজ বিশিষ্ট কেন হয়ে গেল সেটা তাকে সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে। টেবিলের ড্রয়ারটা টেনে একটা নিলচে ঈষদ মোটা কাগজ দিয়ে তৈরি হাতে বানানো খাম বার করে টেবিলের ওপর রাখে ঘোষাল। খামটা খোলার জন্য হাত বাড়াতে গিয়েও হাতটা পেছনে টেনে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খামটাকে আবার যথাস্থানে রেখে দেয় সে।
পরদিন থানায় আসতেই নিলয়ের টেবিলে রাখা ল্যান্ডলাইন ফোনটা বেজে ওঠে।
হ্যালো..ইন্সপেক্টর নিলয় বলছি।
গুড মর্নিং ইন্সপেক্টর নিলয়। আমি ডঃ রায় বলছি।
মর্নিংটা মোটেও গুড নয় ডঃ রায়। তিনপাড়ায় তিনবছরের ওপর কোন মার্ডার কেসের হদিশ ছিল না। সেখানে একদিনেই দু'দুটো লাশ দেখা গেছে। ওপর থেকে যে কী সাংঘাতিক প্রেসার..উফফ!
শান্ত হন ইন্সপেক্টর নিলয়। মর্নিংটা আজ সত্যিই গুড। আপনি কী একবারে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে আসতে পারবেন?
হমম নিশ্চয়ই। আমি আধঘন্টার মধ্যেই পৌঁছাচ্ছি।
ইন্সপেক্টর ঘোষাল তখনও থানায় এসে পৌঁছান নি। নাইট শিফ্টের উদয় বলছিল স্যার নাকি বেশ রাত করে বাড়ি ফিরেছেন। উদয় তখনও থানায় ছিল। নিলয় উদয়কে বলে বেরিয়ে এল। তিনপাড়ার রাস্তাঘাট এখনও পুরোপুরি পাকা হয় নি। কয়েকটা পিচ ঢালাই রাস্তা হলেও বেশিরভাগই ইট মাটির রাস্তা। ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টটা তিনপাড়া ছাড়িয়ে গোহাটায়। ডিপার্টমেন্টটায় খুব আধুনিক সরাঞ্জাম না থাকলেও মোটামুটি কাজ চলে যাওয়ার মতো ব্যবস্থা আছে। খুব গুরুতর কিছু যাচাই করার থাকলে সেটা কোলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নিলয় গোহাটায় যেতে যেতে ভাবে এই দশবছরে কত পরিবর্তন হয়েছে তিনপাড়া। স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তা, আলো, জল, গ্যাস, ট্রাফিক পুলিশ সবটার পরিবর্তন দেখেছে নিলয়। আগে এখানে খুব জড়া ব্যাধি লেগে থাকতো। এদিক-ওদিক পচা ডোবা, নোংরা জল। নতুন প্রশাসন আসার পর জায়গাটার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বাইক চালিয়ে গোহাটায় ঢোকে নিলয়। হঠাৎ তার বাইকের সামনে একটা ত্রিশ একত্রিশ বছরের লোক হুমড়ি খেয়ে পড়ে। হঠাৎ চলন্ত বাইকের সামনে এভাবে আচমকা ঝাপটে পড়ায় লোকটি চোট পায়। হাতে একপাশ থেকে গলগলিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। নিলয় এবার লোকটিকে লক্ষ্য করে। উস্কোখুস্কো চেহারা। পড়নে অসম্ভব ময়লা জামাকাপড়। তার থেকেও যেটা সবথেকে বেশি উৎকট, তা হল একটা বিশ্রী পচা গন্ধ লোকটার গা থেকে আসছে। লোকটা মাতাল। নিলয় আরোও লক্ষ্য করে যে লোকটা কিছু একটা বিরবির করছে। নিলয় শোনার চেষ্টা করেও কিছু বুঝতে পারছে না। কয়েক মিনিটের সময় নিলো লোকটি। ধাক্কা খেয়ে চোট পাওয়া সত্ত্বেও লোকটি আবার উদভ্রান্তের মতো সামনের দিকে দৌড়ুতে থাকে। নিলয় চিৎকার করে ডাকে, 'আরে..শুনছেন। দেখে রাস্তা পার হন।'
কিন্তু নিলয়ের কথাগুলো লোকটির কানে ঢুকলো কিনা সেটা নিলয় বুঝতে পারল না। নিলয় কী ভেবে লোকটির পেছন পেছন বাইক নিয়ে ছুটলো। যে রাস্তায় নিলয় যাচ্ছিল সেটা সোজা গোহাটায় গিয়ে থামবে। আর বাঁদিকে বাঁক নিলেই একটা বিশাল বিল পড়বে। বর্ষাকালে ওই বিলের ধারে প্রচুর ভীড় হয় মাছ ধরার জন্য। লোকটা হঠাৎ ওদিকে দৌড়ালো কেন? এখন তো বিলের জল শুকিয়ে তলায় চলে এসেছে। কী মনে হতে নিলয় লোকটার পিছু নেয়। বাইকটা ঘুরিয়ে বাঁদিকের রাস্তাটায় ঢুকে লোকটিকে দেখতে পায় না সে।
আশ্চর্য এরই মধ্যে কোথায় চলে গেল লোকটি।নিলয় আরো একটু এগিয়ে যায়। আর খানিকটা গেলেই বিল। বিলের পাড়টা খুব উঁচু। পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালে তবেই বিলের জল দেখতে পাওয়া যায়। বর্ষাকালে প্রচুর জল থাকলেও গ্রীষ্মকালে জল প্রায় থাকেই না। কাদাজল হয়ে থাকে। জায়গাটা একটু নিরিবিলি। বিলের কাছে এগিয়ে এসে নিলয় বাইক থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দের সাথে গাছের শিরশির শব্দ মিশে গ্রীষ্মের মধ্যাহ্ন সময়কে আরো নিস্তব্ধ করে তুলেছে। নিলয় বাইক থেকে নেমে এবার সোজা যায়। সামনে আর পথ নেই। একটা বড় টিলা উঠে গেছে পথের শেষে। একটু হতাশ হয়ে পেছনে ফিরতেই নিলয়ের কানে কিছু কথা ভেসে আসে।
সমাধান..সমাধান না হলে নিস্তার নেই।কথাগুলো বোঝা গেলেও সেগুলো বেশ কেটে আসছিল। শুনলে মনে হবে কেউ হয়তে মুখ চেপে চেপে কথাগুলো বলছে। নিলয়ের কী মনে হতে ছুটে বিলের ধারে আসে। পাড়ে গিয়ে দাঁড়াতেই নিলয়ের চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। সে দেখতে পায় কিছুক্ষণ আগে বাইকে ধাক্কা খাওয়া লোকটি বিলের জলকাদায় নেমে দুহাতে নিজের গলা চেপে ধরে একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে, 'সমাধান.. সমাধান না হলে নিস্তার নেই।'
নিলয় সেই দৃশ্য দেখে 'এই, এই' বলতে বলতে ছুটে যায় লোকটির কাছে।তিনপাড়ার পূর্বদিকে একটা জনপদ আছে যার নাম ফরিঘাটা। ফরিঘাটায় বসবাসযোগ্য ব্যবস্থাপনা অতটা ভাল নয়। কারণ ফরিঘাটে চারদিকেই জলঘেরা। মূলতঃ চাষবাস করেই এখানকার লোকদের দিন চলে। জলজ জায়গা হওয়ার বেশ বড় এলাকা হওয়া সত্ত্বেও এই ফরিঘাটে প্রায়ই রোগব্যাধি লেগেই থাকে। কাজকর্মেরও তেমন সুবিধা নেই। অনেকেই তাই ফরিঘাট ছেড়ে তিনপাড়া, গোহাটায় গিয়ে বসতি গড়েছে। ফরিঘাটের কাঁঠাল বাগান পেরিয়ে দু'পা এগুলেই একটা একতলা হালকা কমলা রঙের বাড়ি পড়ে। ফড়িঘাটের মধ্যে সবচেয়ে বড় বাড়ি এটা। একটা দীর্ঘদেহী লোক বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। পায়ের চপ্পলে পুরু ধুলোর আস্তরণ। বোঝা যাচ্ছে অনেকটা দূর থেকে হেঁটে আসছে লোকটা। গায়ে একটা সাদামাটা হাফশার্ট আর ট্রাউজার। চোখেও তার একটা মোটা চশমা। বাড়িটার সামনে এসে লোকটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেটে হাত দিয়ে চাবি বার করে গেটটা খুলে বাড়ির ভেতরে ঢোকে। বাড়ির ভেতরটা যেকোন একটা সাধারণ গৃহস্থের মতোই সাজানো। শুধু বাড়িটা একটু অপরিস্কার। লোকটা বাড়ির ভেতরে ঢুকে দরজার পেছন থেকে ঝাঁটাটা নিয়ে ঘর ঝাঁট দিয়ে শুরু করে।
নিলয় অনেক্ষণ ধরে ইমার্জেন্সি কেবিনটার বাইরে পায়চারী করে যাচ্ছে। একটু পরে কেবিনের ভেতর থেকে ডক্টর রায় বেরিয়ে এসে বলেন, 'সিমিলারলি।'
প্রচণ্ড চমকে নিলয় বলে, 'হোয়াটট! কী বলছেন কী!'
নিলয় বিলের কাদাজল থেকে লোকটিকে উদ্ধার করে খুব দ্রুত গতিতে হাসপাতালে নিয়ে পৌঁছায়। কিন্তু লোকটিকে সে বাঁচাতে পারে নি। লোকটিকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছনোর কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকটি মারা যায়। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে মনে হয় লোকটি বিষক্রিয়ায় মারা গেছে। কিন্তু নিলয় যে লোকটাকে মরার ঠিক আগে পর্যন্তও দেখেছে। তার গোটা শরীরে ব্যবহারে বিষক্রিয়া জনিত কোন লক্ষণ ছিল না। নিলয় ইন্সপেক্টর ঘোষালকে ফোন করে। ফোনটা বেজে বেজে বন্ধ হয়ে যায়।
দাঁত কিরমির করে নিলয় মনে মনে বলে, 'যখন আমার প্রয়োজন তখন আর ফোনটাতে পাওয়া যায়। আর যখন নিজের প্রয়োজন থাকবে তখন সময়-অসময়েও ফোন করে দেবে।'নিলয় এতটুকু বুঝতে পারে যে যতটা ঘোষাল তাকে অপছন্দ করে তার চেয়েও বেশি সে ঘোষালকে অপছন্দ করে। এসব ভাবনার মধ্যে নিলয়ের ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে, "ইন্সপেক্টর ঘোষাল কলিং"।
হ্যালো স্যার।
হ্যাঁ ফোন করেছিলে..বলো।
স্যার আপনি কোথায়?
আমি কোথায় সেটা জেনে তোমার কী হবে?
না মানে স্যার একবার যদি হাসপাতালে আসতেন…আসলে আরো একজনের মৃত্যু হয়েছে।
ডঃ রায়ের কেবিনে তখন ডঃ রায়, ইন্সপেক্টর ঘোষাল এবং নিলয় বসে আছে। কেবিনের পরিবেশটা বেশ থমথমে। তিনটে লোক তিনদিনের ব্যবধানে পর পর মারা গেল অথচ এখনও পর্যন্ত এই অকস্মাৎ মৃত্যুগুলোর কারণ জানা গেল না। আর যদি সন্দেহের খাতিরে এই মৃত্যুগুলোকে খুন বলে ধরে নেওয়াও হয় তাহলে এর পেছনে উদ্দেশ্যটাই বা কী? উফ্! নিলয় আর ভাবতে পারছে না। মাথাটা যেন ফেটে যাবে এবার।
ডঃ রায় এবার ঘরের নৈঃশব্দ ভেঙে মুখ খোলেন, 'এই তিনটে মৃতদেহতে একটা সাবস্টেন্স পাওয়া গেছে। কিন্তু সাবস্টেন্সটা কী সেটা বুঝতে পারছিলাম না। আগের মৃতদেহগুলোতে সাবস্টেন্সটার একটা ট্রেস পাচ্ছিলাম কিন্তু আইডেন্টিফাই করতে পারছিলাম না। হয়তো মানুষদুটোর মৃত্যু এবং আমাদের কাছে তাদের দেহ পৌঁছানোর সময়ের মধ্যেই সেই পার্টিকেলটা এলিমিনেট হয়ে শুধু তার একটা ট্রেস রেখে গিয়েছিল। কিন্তু এই লোকটার মৃত্যু এখানে হয়েছে। তাই তার পোস্টমর্টেম করার পর আমি ওই ইলিমেন্টটার খোঁজ পেয়েছি। এলিমেন্টটা নিয়ে টেস্ট করি। টেস্ট রেজাল্ট সাংঘাতিক। এই এলিমেন্টটা আসলে নিমোনিয়ার ওষুধ। তবে এটা এখন ব্যবহার করা ব্যানড। কিন্তু এটা ওই ওষুধটার অরজিনাল ফর্ম নয়। এটা মিউটেন্ট।'
নিলয় মারাত্মক চমকে বলে, 'কী বলছেন মিউটেন্ট মেডিসন!
ডঃ রায় কপালটা কুঁচকে বলেন, 'হ্যাঁ। কিন্তু একটা মেডিসিনকে মিউটেন্ট করার জন্য কাউকে যথেষ্ট পড়াশোনা জানতে হবে। কিন্তু সবচেয়ে প্রশ্ন হল কেউ এটা করবে কেন? আর যদি করেও থাকে তাহলে এই মিউটেন্ট মেডিসিনটা এদের শরীরে কেন পাওয়া যাচ্ছে?'
'মনে হয় মেডিসিনটা কেউ ওই মানুষগুলোর ওপর প্রয়োগ করে দেখছে। ওই যেরকম ল্যাবরেটরিতে ইঁদুর, গিনিপিগের ওপর নতুন আবিষ্কৃত ওষুধ প্রয়োগ করা হয় তেমনি', বেশ ভরাট গলায় বলেন ইন্সপেক্টর ঘোষাল।নিলয় বেশ চমকে উঠে বলে, 'কিন্তু স্যার এটা তো নৃশংসতা। একটা জীবন্ত মানুষের ওপর ওষুধের পরীক্ষণ করা তো পাশবিকতা।'
ইন্সপেক্টর ঘোষাল একটু গর্জে উঠে বলেন, 'ল্যাবরেটরিতে যখন ওই নিরিহ প্রাণীগুলোর ওপর ওষুধের পরীক্ষণ হয় তখন সেটা পাশবিক আচরণ হয় না বুঝি!'
নিলয় আমতা আমতা করে বলে, 'ন..না..ম..মানে..।'
ঘোষাল আর কোন কথা না শুনে বড় বড় পা ফেলে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসেন।
ডঃ রায় বলেন, 'আরে উনি তো পুরো কথাটা না শুনেই বেরিয়ে গেলেন।'
নিলয় বলে, 'কী কথা?'
'আমি ভিক্টিমের হাতে এই জিনিসটা পেয়েছি', কথাটা বলে ডঃ রায় একটা জিনিস নিলয়ের হাতে দেন।
নিলয় দেখে সেটা একটা বোতাম। ঘিয়া রঙয়ের বোতাম। বোতামটার এপিঠ ওপিঠ দেখে নিলয় সেটা পকেটে রেখে দেয়।
বেরোনোর মুখে হঠাৎ পেছন ঘুরে নিলয় জিজ্ঞেস করে, 'আচ্ছা ভিক্টিমের সাথে আততায়ীর কোন সংঘর্ষের চিহ্ন দেখতে পেয়েছেন কী ডঃ রায়?'
ডঃ রায় বললেন, 'ঠিক সংঘর্ষ নয় তবে এটটু হাতাহাতি যে হয়েছে সেটার চিহ্ন পেয়েছি। সম্ভবত আততায়ীর হাতের কোন একটা নখ বেশ বড় এবং তিক্ষ্ণ। কারণ ভিক্টিমের কাঁধে একটা গভীর ক্ষত আছে। আর ক্ষতটা যে নখের আঁচড় তাতে কোন সন্দেহ নেই।'
খুব আশ্চর্য হয়ে নিলয় বলে, 'নখ!'
নিলয় একটু চুপ থেকে বলে, 'আচ্ছা যদি এগুলো হত্যা হয় তাহলে আপনি কী ক্রিমিনাল নিয়ে আরো কিছু বলতে পারবেন?'
ডঃ রায় হালকা হেসে বলে, 'নিলয় আমরা একটা সভ্য সমাজে বাস করি। সেখানে কারোর প্রাণ হরণ করা নিশ্চিন্তরূপেই অপরাধ এবং যে এই অপরাধটা করছে সে অপরাধী। অপরাধী সম্পর্কে একটা কথা বলতে পারি যে সে নিজের আশপাশ নিয়ে খুব ক্ষুণ্ণ। সমাজে সকল ধরনের মানুষ থাকে। একজন রিক্সাওয়ালা থেকে একজন কর্পোরেট অফিসার যেমন সমাজের অংশ তেমনি ভিখিরী, পাগল, মাতাল, মাদকাসক্ত ব্যক্তি তারাও কিন্তু সমাজেরই অংশ। হ্যাঁ হতে পারে তারা সমাজের কোন কাজে আসে না, সমাজকে দূষিত কলুষিত করে! তবুও তারা যে সমাজের অংশ সেটা কিন্তু অস্বীকার করি যাবে না। যে ওষুধটার কথা বললাম সেটা কিন্তু নিমোনিয়া নিরাময়ের জন্য তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এখন এই জীবনদায়ী ওষুধটাই মারণাস্ত্র হয়ে উঠেছে এবং দেখে দেখে সেইসব লোকদের নিশানা করছে যারা সমাজের কলঙ্ক।'
নিলয় উত্তেজিত হয়ে বলে, 'কিন্তু ডঃ রায় প্রশ্নটা তো থেকেই যাচ্ছে। আততায়ী কেন ওদেরকে টার্গেট করছে? আর আততায়ী কী একজন না অনেকে?'
ডঃ রায় বলেন, 'দেখো যদ্দুর আমার জ্ঞান বলছে আততায়ী একজনই। যদি দুজন হত তাহলে মৃতের সংখ্যা তিন হত না, আরো বেশি হত। মনে রাখতে হবে এই অঞ্চলে ভিখিরী বা মাতালদের সংখ্যা নেহাৎ খারাপ নয়। আর আততায়ী যখন হত্যার জাল বিছিয়ে দিচ্ছে তখন টার্গেটকে নির্জন এলাকার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যাতে কেউ তাকে বাঁচাতে না পারুক।'
ডঃ রায়ের কথাগুলো নিলয়ের মাথার ভেতরে ঘুরতে থাকে। কিন্তু সে থানায় ফিরে এসে দেখে গতকাল যে দুজনকে মাঝরাতে রাস্তার মাঝে বসে জুয়োখেলার অপরাধে ধরে জেলে পুরে রাখা হয়েছিল তাদের আজ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আগামীকাল তাদেরকে কোর্টের তোলার ছিল। কিন্তু তার আগেই কী করে তদের ছাড়া হতে পারে। নিলয় সেসময় যে স্টেশনে উপস্থিত ছিল তাকে ডাকে।
এই, এইদুজন কোথায় রে? কাল তাদের কোর্টে তোলার আছে।
স্যার তাদের তো জামিন হয়ে গেছে।
কী!! কে করল জামিন?
স্যার একজন উকিল এসেছিল। কাগজপত্র দেখালো। তারপর ফাইন ভরে জামিন করিয়ে নিয়ে চলে গেল।
কী এমনি এমনি নিয়ে চলে গেল! তুমি জিজ্ঞেস করো নি যে তাকে এখানে কে পাঠিয়েছে?
না স্যার। অতবড় উকিল এসেছেন। তাকে কিভাবে জিজ্ঞেস করতাম স্যার। তারা কী এখান থেকে যাওয়ার আগে কিছু খেয়েছিল।
হ্যাঁ স্যার ওই উকিল বাবুই তাদের জন্য ফ্লাক্সে করে শরবৎ নিয়ে এসেছিলেন। জামিন হওয়ার পরেই তারা এখানেই দাঁড়িয়ে শরবৎটা খেল। তারপর বেরিয়ে গেল উকিল বাবুর সাথে।
কোন্ দিকে গেছে?
স্যার সেটা তো দেখি নি।
নিলয় ধপ্ করে বসে পড়ে চেয়ারে। মনে মনে ঘটনাগুলোকে ক্রম অনুযায়ি সাজাতে থাকে। তারপর কিছু একটা ভাবতেই তার গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে থানা থেকে ফোর্স নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। জুয়াড়ি দুজনের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। দুটো মানুষ হঠাৎই যেন হাওয়ায় উবে গেল।
বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা নেমেছে। ফড়িঘাটের এই জায়গাটা অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ একটু বেশিই নিস্তব্ধ। অবশ্য সময়টাকে দিন না বলে রাত বলাই শ্রেয়। কমলা বাড়িটা এখন আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। অন্ধকারের মিশমিশে কালো রঙে সে ঢাকা পড়ে গেছে। সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকার গায়ে মেখে লোকটা বাড়িটার সামনে দাঁড়ায়। পকেট থেকে চাবি বার করে গেটের তালা খুলে বাড়ির ভেতরে ঢোকে। ঘরে আলো জ্বালিয়ে সে সোজা ডানদিকে ঘুরে দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবির কাছে আসে। দেঝয়াল থেকে ছবিটা নামাতেই দেখা যায় সেখানে আরো একটা চাবি ঝুলছে। চাবিটা হাতে নিয়ে ছবিটা আবার যথাস্থানে রেখে লোকটা
পেছন ঘুরে বাঁদিকের একটা ঘরে ঢোকে। ঘরটায় উত্তরদিকের দেওয়ালে একটা দরজা আছে। দরজাটা খুলতেই একটা ঘোরানো সিড়ি চলে গেছে ওপরের দিকে। ঘোরানো সিড়িটা ধরে ওপরে গেলে আরো একটা ঘর পড়ে। ঘরের দরজাটা লক করা। হাতে ধরা চাবি দরজায় লাগিয়ে দুপ্যাঁচ দিতেই দরজাটা খুলে যায়। দরজাটা খুলতেই ভেতর থেকে একটা উৎকট গন্ধ নাকে আসে। ঘরটায় একটা লাল আলো জ্বলছে। ঘরটায় চারদিকে ছোট বড় আকারের টেবিল। সেই টেবিলের ওপর বিভিন্ন আকারে বিকার, টিউব, ফানেল। তাতে রঙবেরঙের তরল। তরলগুলোর কোনটা ছেঁকে জমা হচ্ছে টিউবে, কোনটা বা ল্যাম্পের ওপর রাখা, কোনটা আবার টগবগিয়ে ফুটছে। লোকটা গিয়ে দেওয়ালের হুকটা থেকে ল্যাবকোটটা নিয়ে পড়ে নেয়। একটা টেবিলের ড্রয়ার থেকে ল্যাব গ্লাস বার করে চোখে পড়ে নেয়। তারপর একটা বিকারের কাছে গিয়ে তরল নিয়ে টিউবে রেখে তার পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
তারপর আবার ফিরে আসে নিচের ঘরে। বাঁদিকের ঘরটা থেকে বেরিয়ে সামনের ঘরটায় আসতে লাইটটা ঝুপ করে বন্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে চার পাঁচটা টর্চের আলো একসাথে গিয়ে পড়ল লোকটার মুখের ওপর।
লোকটা একহাতে মুখের ওপর পড়া আলোটা ঢাকতেই নিলয় প্রায় গর্জে উঠে বলে, 'খবরদার দিগ্বিজয় পান্ডে ওরফে ইন্সপেক্টর ঘোষাল ওরফে দিগ্বিজয় ঘোষাল। আপনার পুলিশ ট্রেনিংটা কোন অ্যাকাডেমি থেকে হয়েছিল সেটা কিন্তু আমার জানা হল না। ওখান থেকে এক'পাও নড়ার চেষ্টা করবেন না। নইলে আমার হাতে ধরা বন্দুকের গুলিটা কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে না।'
একজন কনস্টেবল গিয়ে দিগ্বিজয় পাণ্ডেকে হাতকড়া পড়িয়ে দিতেই নিলয় ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দেয়। কিন্তু এই যে এতকিছু হয়ে গেল তাতে কিন্তু দিগ্বিজয়ের মুখের রেখার কোন পরিবর্তন হয় নি। বরং সে কী যেন একটা বিরবির করে যাচ্ছে। নিলয় কান পেতে শুনতে পায় দিগ্বিজয় বলছে, 'সমাধান..সমাধান না হলে নিস্তার নেই।'
নিলয়ের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। সে চিৎকার করে বলে, 'শিগগিরই একে হাসপাতালে নিয়ে চলো। এ ওই বিষটা খেয়েছে। শিগগির.. শিগগির। তাড়াতাড়ি করো।'
বেশ অনেক্ষণ পর ডক্টরের কেবিনে নিলয়ের ডাক পড়ে। নিলয় কেবিনের দরজায় নক করে বলে, 'আসবো ডক্টর।'
হ্যাঁ, হ্যাঁ। আসুন।
পেশেন্টের অবস্থা কেমন?
এখন আপাতত বিপদমুক্ত।
ইনি কী আপনার কেউ হন?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিলয় বলে, 'না ডক্টর। ও একজন ক্রিমিনাল। আচ্ছা ওই দুজনের খবর কী?'
ডক্টর বলেন, 'তারা ভাল আছে। এখন রিহ্যাবিলিটেশন ক্যাম্পে আছে। আর তাদের প্রোগ্রেসও বেশ ভাল। সেদিন যদি তাদের সময়মতো হাসপাতালে না নিয়ে আসতেন.. তাহলে হয়তো বাঁচাতে পারতাম না।'
নিলয় কিছু না বলে সামান্য হেসে উঠে দাঁড়ায়।একদিন ডঃ রায় নিলয়কে ডেকে পাঠান। নিলয় আসতেই তিনি নিলয়কে চেপে ধরেন কেসটা খোলসা করতে।নিলয় একটু হেসে বলতে শুরু করে, 'আমি এলাকায় নতুন এসেছি। আমার একটা স্বভাব আছে। নতুন কোথাও গেলেই আমি আগে আশপাশটার সম্পর্কে খবর নেই। জানতে পারি যে বেশ অনেক বছর আগে এই অঞ্চলের ফরিঘাটায় নিমোনিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটে। তখন জায়গাটা এত শুকনো ছিল না। চারদিকে ডোবা, বোঁজা পুকুর, স্যাতস্যাতে রাস্তঘাট। সর্দি কাশি প্রায় সারাবছর লেগে থাকত। নিমোনিয়াটা ছিল তখন সাধারণ ব্যাপার। যদিও পরে জানা গিয়েছিল যে আসলে এলাকাটা নোংরা থাকায় এখানকার লোকজনরা এত অসুস্থ হয়ে পড়তো। সেসময় বেশ অনেকজন মারা যায়। সেখানে দিগ্বিজয় পান্ডের পরিবারও মারা যায়। দিগ্বজয় নিজে ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু তার সাংঘাতিক রকমের ক্যামিকেল রিয়েকশন হয়। সবটাই অবশ্যই এলাকার আনহাইজিন পরিস্থিতিতে বড় হওয়ার জন্য। এরপর সে ভাবে যাদের জন্য তার জীবন তার পরিবার শেষ হয়ে গেছে তাদেরকে সে শেষ করে দেবে। তাই ভূয়ো নাম করে এই তিনপাড়ার থানায় আসে। সে বুদ্ধি করেই এইরকম গ্রামে এসে জয়েন করে। কারণ বড় শহরে গেলে সে ধরা পড়ে যেত। সেদিন যখন আপনি বললেন যে আততায়ীর বড় নখ আছে তখন আমার মনে পড়ল যে দিগ্বিজয়ের বাঁহাতের একটা আঙ্গুলের নখ খুব বড়। পুলিশের ট্রেনিং নেওয়া থাকলে সে ডিসিপ্লিন ম্যানুয়াল ফলো করবে। যার মধ্যে নখ বড় রাখা নিষিদ্ধ। আমার একটু সন্দেহ জমতে শুরু করে। সন্দেহ করার আরো একটা কারণ হল দিগ্বিজয়ের জুতো। জুতোগুলো আপাত দৃষ্টিতে পুলিশের জুতো মনে হলেও সেটা পুলিশের জুতো নয়। ওটা স্পেশালি মেইড মেডিকেটেড জুতো। যার পায়ে সমস্যা এবং যার ডিসিপ্লিনারি ফল্ট আছে সে কিভাবে পুলিশ হতে পারে। আমি আরো লক্ষ্য করলাম হত্যার জায়গায় তিনি উপস্থিত থাকলেও একটু পরেই কোথাও হাওয়া যেতেন। তারপর তাকে ফোনেও পাওয়া যেত না। একদিন তাকে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে ফলো করলাম। সেদিন ওই মাতালটা মারা গিয়েছিল। দেখলাম তিনি র দিকে যাচ্ছেন। সেখানে একটা বাড়িতে ঢুকলেন। আমি চুপিসারে পা টিপে টিপে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলাম দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবির দিকে তাকিয়ে তিনি জোড়ে বলছেন, "সমাধান..সমাধান নি হলে নিস্তার নেই।"
চকিতে আমার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল..এই একই কথাটা তো ওই মাতালটাও বিরবির করছিল। তাহলে ওটা ওষুধের প্রভাব যা ব্রেইন ব্লক করিয়ে দেয় না কি অন্যকিছু। আমি ছুটে থানায় এসে দিগ্বজয় ওরফে ইন্সপেক্টর ঘোষালের টেবিলে সার্চ করি। টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা মোটা কাগজের খাম পাই। খামটার ভেতরে একটা ছবি। ছবিটা হুবহু এক, ওই ফড়িঘাটের বাড়িটার ছবির মতো। ব্যাস দুয়ে দুয়ে চার করে নিলাম। প্ল্যান করে জুয়াড়ি দুজনকে ধরলাম। ভাবলাম উনি হয়তো থানার মধ্যেই কাজটা করবেন। কিন্তু না তিনি বেশভূষা পাল্টে উকিল সেজে এসে তাদের ছাড়িয়ে নিলেন। আর মিউটেন্ট মেডিসিনটাও খাইয়ে দিলেন। আমি ফোর্স নিয়ে ওদের ডেরা থেকে তখনই গিয়ে পিক করে নেই এবং যথারীতি উকিলবেশী ইন্সপেক্টর ঘোষাল সেখানে ছিলেন না। আর তাকে ফোন করেও পাই নি। তবে এবার আমি জানতাম তাকে কোথায় পাওয়া যাবে।'
ডঃ রায় হাততালি দিয়ে বলেন, 'ব্র্যাভো নিলয়। ব্র্যাভো!'
একগাল হেসে নিলয় বলে, 'ধন্যবাদ ডঃ রায়। এবার যেটার লোভ দেখিয়ে ডাকলেন সেটা কই!'
ডঃ রায় জোরে হেসে বললেন, 'এই নাও আমার লেখা নতুন এডিশন অন ফরেনসিক সায়েন্স।'
নিলয় বইটা হাতে নিয়ে বলে, 'দিগ্বিজয়ের অনেক জ্ঞান ছিল। কিন্তু সেটা সে ভুল জায়গায় ব্যবহার করেছে। বই আর জ্ঞান থেকে বড় শক্তি পৃথিবীতে কিছু নেই ডক্টর। যেদিন এই দুটো মহাশক্তিকে মানুষ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে শিখবে সেদিন হয়তো যথার্থই আমরা ঈশ্বরের কৃত শ্রেষ্ঠ জীব হয়ে উঠবো।'