ছবি- সংগৃহীত
অনন্যা কাজ থেকে ফিরে দরজায় চাবি খুলে ভেতরে ড্রয়িং রুমে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কিন্তু তাঁর চোখে জল মোছানোর কেউ নেই। থাকবেই বা কি করে ? টু বি এইচ কে ফ্লাটে একদম একা থাকে। ফুলের মত জীবনটা যেন তেজপাতা হয়ে গেছে, শুকিয়ে । বাড়ির কাজের লোক টা আসে সকালে। ঘন্টা খানেক কাজ করে চলে যায়। ওর সঙ্গেই যা একটা সুখের দু:খের কথা হয়।
জেদি একগুঁয়ে স্বাধীনচেতা অনন্যা গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরের উদ্দেশ্যে নিজের পায়ে সাবলম্বী হওয়ার লক্ষ্যে পাড়ি দিয়েছিল। কলেজ পাশ করার পরেই বাবা-মা বিয়ের যোগাযোগ করছিল। কিন্তু অনন্যার তাতে সায় ছিল না। সুন্দরী , ফর্সা স্লিম ও আধুনিক মনস্কতা হওয়ায় অনেক প্রেমের আমন্ত্রণ পেয়েছিল জীবনে, কিন্তু সেই ভাবে হয়তো কেউ তাঁর মনে রেখাপাত করেনি। কলেজের পড়াশোনা চলাকালীন বিউটিসিয়ান কোর্স করেছিল। স্কুলে পড়াকালীন হাত খরচ নিজেই চালাতো টিউশনি পড়িয়ে। কলেজে দু একটা সিগারেটের টান বা দু এক পেগ মদও মাঝে মাঝেই খেতো। আধুনিকা আল্ট্রা মডার্ন। পোশাকের উপর ওর যেন একটা আলাদা আসক্তি ছিল। মাসে অন্তত কয়েকবার শপিংমলে না গেলে ওর যেন খেয়ে হজম হতো না, রাত্রে ঘুম ভালো হতো না। আলমারি ভর্তি হয়ে উপচে পড়ছে নানান বাহারি পোশাক। একটা ড্রেস একবার পড়লে ও আর দ্বিতীয় বার পড়বে না। ইনিস্টাগ্রামে রিল বানানো ওর নেশা, হয়তো অভিনেত্রী হওয়ার একটা প্যাশন ছিল। বন্ধু বা বান্ধবী নেহাত কম ছিল না। বখাটে সুন্দরী বললে ভুল হবে না। গভীর রাত পর্যন্ত বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটি বা মোবাইল চ্যাটিং এ বেশ অভ্যস্ত। এইভাবেই বেশ চলছিল কিন্তু হঠাৎ বাড়ির চাপে বিয়ের তোড়জোড়ে, বিএড কোর্স টা কমপ্লিট করেনি।
বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে একটা চিঠি লিখে অন্তর্ধান হয়। চিঠিতে লেখা ছিল: প্রিয় বাবা-মা,
আমি তোমাদের ছেড়ে চললাম স্বাধীনভাবে বাঁচতে, ভয় নেই কারো সঙ্গে পালাইনি। বংশের মুখে চুনকালি লাগাবো না এটুকু কথা দিতে পারি। কাছাকাছিই হয়তো থাকবো। আমাকে খোঁজার চেষ্টা কোরো না। কারণ যে নিজে থেকে হারিয়ে যায়, তাঁকে কেউ খুঁজে পায় না। ইতি তোমাদের অণু।
বর্তমানে বর্ধমানে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করেই থাকে। কিছু দূরে তার নিজস্ব বিউটিশিয়ান সেন্টার রয়েছে। রূপচর্চার পাশাপাশি বিউটিশিয়ান কোর্সের ডিপ্লোমা ও ট্রেনিংয়েরও ব্যবস্থা আছে সেখানে। সরকার অনুমোদিত সার্টিফিকেটের দেওয়া হয় কোর্স শেষে। অনেক মেয়েই সাবলম্বী হয়ে বাঁচতে চায়,নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। তাই ছাত্রীর সংখ্যা নেহাত কম না। মোটামুটি সচ্ছল ভাবেই তাঁর জীবন চলে যাচ্ছিল।
সারাদিন কাজ করার পর রাত্রে যখন বাড়ি ফেরে , একাকীত্ব যেন তাকে গ্রাস করে দিনের পর দিন। একটা সময়ের পর, মানুষ আর একা থাকতে পারে বলাবাহুল্য একা বাঁচতে ইচ্ছে করে না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী বরাবর লতানো গাছের মত। কাউকে না কাউকে অবলম্বন করে তাকে জীবনে বাঁচতে হয় ,এটাই নিয়ম, চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।তবুও জীবনের বাঁধা ছক, চেনা গন্ডির বাইরে অনন্যার এই পথচলা প্রশংসার দাবিদার রাখে ওর জীবনে। ও যে ফ্লাটে এ ভাড়া থাকে ওখানে কয়েক টা পরিবার থাকে কিন্তু পূজা বা অকেশন ছাড়া কোন যোগাযোগ নেই কারো সঙ্গে। যেমনটা হয়, শহরাঞ্চলে ফ্ল্যাটের বসবাস কারী পরিবারের লোক, পাশের ফ্ল্যাটের লোককে চেনে না। শহরের উঁচু উঁচু ফ্ল্যাট বাড়িগুলো যেন কংক্রিটের জঙ্গল। মানুষ যেন যন্ত্র চালিত হয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞানের যত উন্নতি হচ্ছে। মেট্রো বাসে প্রায়ই দেখা ঘাড় হেঁট করে বা কানে ব্লুটুথ হেডফোন গুঁজে অনেককে মোবাইল ঘাটতে। পাশের সিটে কে বসলো বা কি বলল কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। যখন মোবাইল ছিলনা ,মানুষ ছিল মুক্ত। এখন মোবাইল মুক্ত মানুষ বন্দী হয়েছে তাঁর নিজের হাতের মুঠোয়।
অনন্যার সেন্টারে যাতায়াতের পথে এইসব লক্ষ্য করে। এই ৩৫ বছর বয়সে মোবাইল ঘাঁটার বাতিক নেই। সোশ্যাল সাইট, বন্ধু সব যেন একটা ফানুস লাগে তার কাছে। কেমন যেন অকৃত্রিম সব। আছে কিন্তু না থাকার মতো। স্বার্থ ছাড়া কেউ কারো খবর রাখে না এখন, কারণ সময়ের মূল্য যে অমূল্য।
অনন্যার একটি স্মৃতি মনে পড়ে যায়। ওর প্রিয় কুকুর পমিডাইন ছিল যাকে ও সন্তানের মতো ভালোবাসতো। কুকুরটির খাওয়া-দাওয়া দেখভাল সবকিছু ওর দায়িত্ব ছিল। একদিন বাড়ির কাছে একটি মধ্যবয়সী যুবকের সঙ্গে ওর দেখা হয়। ওর দাদার সঙ্গে পুরুষটির পরিচিতি ছিল। পুরুষটি ওকে দেখামাত্রই প্রেমে পড়েছিল। কিন্তু ওকে বুঝতে দেয়নি প্রথমে। ফোন নাম্বার আদান প্রদান হলো। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হতো কয়েক মিনিট। প্রেমালাপ ঠিক নয়। সাংসারিক জীবন, স্বাবলম্বী হওয়া, ইচ্ছা-অনিচ্ছা , নানারকম আলোচনা চলতো বন্ধুর মত । কোথায় কি চাকরির ভেকেন্সি বেরোচ্ছে? কিভাবে এপ্লাই করতে হবে? ইত্যাদি। অনন্যা খুব ব্যস্ত থাকতো ওর বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা বিয়ে বাড়ির কনে বা আত্মীয়ার মেকআপ সিডিউলে।
কয়েকদিন পর পুরুষটি ওকে প্রপোজ করে, মনের কথা খুলে জানায়। পুরুষটির ডিভোর্স মামলা চলছে। স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা হয়নি, মানসিক রোগগ্রস্ত ছিল। তাই অনেক ঝুট ঝামেলা অশান্তির পর নিজে থেকেই বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করে। অনন্যা কে সব খুলে বলেছিল। কিন্তু অনন্যার তরফ থেকে কোন সদুত্তর না পেয়ে যোগাযোগ কমে যায় ধীরে ধীরে। পুরুষটি বিশিষ্ট লেখক ছিলেন, বেশ কয়েকটি বই, পত্র-পত্রিকায় ম্যাগাজিনে দেশে-বিদেশে লেখা বেরিয়েছিল। ওনার অনেক সুনাম আছে লেখা ও কাজের সূত্রে। কিছুদিন আগেই অনন্যা খবর পেয়েছে তিনি মারা গেছেন। আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে।
সেদিনের খবরটা শুনে অনন্যার মনটা খারাপ হয়েছিল। পৃথিবীতে এমন অনেক সম্পর্ক থাকে যার কোন নাম হয় না। কোন বিশেষণ বোধ হয় যথার্থ নয় । নাম দেওয়ার চেষ্টাও হয়তো করে নি। নিঃস্বার্থ ভালোবাসা কোনদিন কোন কিছুর প্রত্যাশা করে না।
রান্নায়, তেজপাতা যেমন ফোরণ বা যে কোন মসলার উপস্থিতির মধ্যে থাকে , জীবনেও ভালবাসার উপস্থিতি তেজপাতার মতো। তেজপাতা (মশলার) উপস্থিতি না থাকলে রান্না যেমন সুস্বাদ হয় না, ভালোবাসার অনুপস্থিতিতে জীবনে কেমন যেন ম্যাড়মেড়ে একঘেয়ে হয়ে যায় না কি ?