ছবি- সংগৃহীত
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ। বর্তমান সময়ে আর্থ-সামাজিক এবং আঞ্চলিক কূটনীতি ও বিদেশনীতিতে যথেষ্ট ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে একসময়ের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ। ফলে একদিকে পশ্চিমাদের নিয়ে ভারত এবং অন্যদিকে চীন, দুই বৃহৎ প্রতিবেশী উভয়েই ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক ও কৌশলগতসহ সম্পর্কের সব বিষয়ে বাংলাদেশকে যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করে। নিজের স্বার্থে বাংলদেশে বিনিয়োগের ধারাকে অধিকতর সমন্বিত এবং বেগবান করতে উভয় দেশ আন্তরিক। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক বহুমুখী এবং দীর্ঘদিনের। ভূরাজনৈতিক বিচারে বাংলাদেশের অন্যতম মিত্র দেশ চীন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ এবং ঋণ প্রদানে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যা বর্তমান সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। পশ্চিমাদের সঙ্গে বিভিন্ন ভূরাজনৈতিক ও নীতিগত নানা প্রশ্নে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের ভিন্নমত ও দূরত্বের কারণে চীনা বিনিয়োগ অনেকটাই কাঙ্ক্ষিত ছিল।
দেশী-বিদেশী গবেষণা সংস্থাসমূহের ও বিভিন্ন উৎসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে চীনের মোট বিনিয়োগের স্থিতি প্রায় ৭-৮ বিলিয়ন ডলার। আবার বিভিন্ন প্রকল্পে চীনা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলো এখন পর্যন্ত নির্মাণকাজের ঠিকাদারি পেয়েছে কমপক্ষে ২২ বিলিয়ন ডলারের। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ আছে ৩৮০০ কোটি ডলারেরও বেশি। এই অর্থের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতামূলক অবকাঠামো প্রকল্পে ২৪৬৫ কোটি এবং যৌথ উদ্যোগী খাতে ১৩৬০ কোটি ডলার। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সর্বশেষ প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রে চীনের কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না। তবে একই সময়ে বড় প্রকল্পে অর্থছাড়ের পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৬ লাখ ৫০ হাজার ডলার। ইআরডি, মার্কিন থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (এইআই) ও চীনা বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৮ বছরে বাংলাদেশে ৭০০ কোটি ডলারের কিছু বেশি পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে চীন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে, যার পরিমাণ ৩২৭ কোটি ডলার। ধাতু (নির্মাণসংশ্লিষ্ট) সরবরাহ খাতে দেশটির বিনিয়োগের পরিমাণ ২১৩ কোটি ডলার। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ১১০ কোটি ডলার। এছাড়া আর্থিক খাতে ১৬ কোটি ও অন্যান্য খাতে ৪১ কোটি ডলার বিনিয়োগ রয়েছে দেশটির। এ ছাড়া ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন নিং সফরের সময় ২০০০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি হয়েছে। অবকাঠামো ও উৎপাদন খাতে চীনা বিনিয়োগ আবার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং বিদেশনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। পাশাপাশি ব্যক্তিগত পর্যায়েও ব্যবসা-বাণিজ্যে ও শিল্প-কারখানাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান হারে চীনা বিনিয়োগ হচ্ছে। মেট্রোরেল, পদ্মাসেতু ও কর্ণফুলি টানেলসহ ছোট বড় প্রকল্প এলাকা ছাড়াও ঢাকার উত্তরা, বনানী, বারিধারা, বসুন্ধরা, ডিওএইচএস এলাকাসমূহ ও বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলসহ পুরাতন ঢাকার বাজার এবং অন্যান্য স্থানের সরকারি ও বেসরকারি অফিসে চীনাদের উপস্থিতি নিশ্চয় চোখে পড়ে। দেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতায়ও চীন আন্তরিক ফলে ব্যবসা বাণিজ্য ছাড়াও বিভিন্ন বৈষয়িক কারণে উভয় দেশের মানুষের মধ্যে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে বিগত সময়ে চীনের বিনিয়োগ এর পরিসংখ্যান চোখ বুলালে সহজে অনুমেয়, দেশে চীনের তুলনায় অন্য দেশের বিনিয়োগ সেভাবে আসছে না। করোনাকালে বিদেশি বিনিয়োগের চ্যালেঞ্জটা অনেক বেশি বেড়েছে। অনেকগুলো বড় খাতে সরকারের সামনে কোনো বিকল্প নেই। এ কারণে চীনের প্রতি বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা বাড়ছে। বাজার অর্থনীতির যুগে বড় বড় প্রকল্পে সরকারের বিনিয়োগ দরকার। সেই দরকার পূরণে সরকার চীনা বিনিয়োগ নিচ্ছে। অস্বীকার করার সুযোগ নেই, চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি বড় শক্তি। এ শক্তিকে বিশ্ব এড়াতে পারছে না। ফলে বাংলাদেশও তার অবস্থানগত যায়গায় এটি এড়িয়ে যেতে পারছে না।
বাংলাদেশে চীনা বিনোয়োগ নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হলে অবশ্যই অন্যান্য দেশে চীনা বিনিয়োগের ধরন ও অভিজ্ঞতা এবং ভারতসহ অন্যান্য দেশ কর্তৃক বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহকে মাথায় রাখতে হবে। বিশ্ব ব্যবস্থা বিশেষ করে অর্থনৈতিক বলয়ে দেশসমূহ মূলত দুই মেরুতে বিভক্ত যথা গণতান্ত্রিত (ভারতসহ পশ্চিমাদের বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব) মেরু এবং সমাজতান্ত্রিক বা সমগোত্রীয় (চীনের নেতৃত্বে রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশ) মেরুতে প্রতিযোগিতামূলক ও সাংঘর্ষিকভাবে বিভক্ত। ফলে একটি দেশে এক ব্যবস্থার বিনিয়োগ বা স্বার্থ রক্ষা হলে অন্যদের ক্ষুব্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সে প্রেক্ষাপটে অধিক হারে চীনা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশেও এই ঝুঁকি থাকাই স্বাভাবিক। আমরা জানি যে চীনের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নতি ও অর্জন অন্যান্য যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি। তারা বিনিয়োগ আর ব্যবস্যা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশে পৌঁছে গেছে। ফলে এসব দেশে ক্রমে পশ্চিমা বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অন্যান্য বিষয়ক স্বার্থ প্রতিযোগিতামূলক, ঝুঁকিপূর্ণ ও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ যথা মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ও পাকিস্তানেও প্রচুর চীনা বিনিয়োগ হচ্ছে এবং নতুন বিনিয়োগ পরিকল্পনা গ্রহণপূর্বক কাজ শুরু করেছে। আমাদের সার্কভুক্ত দেশ ছাড়াও ভিয়েতনাম, লাওস, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, (২০১৪ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঁচটি দেশকে ২০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করে) ও মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশে চায়নিজ বিনিয়োগ আছে। পাশাপাশি কেনিয়া, সুদান, জাম্বিয়া, কঙ্গো, মিসর, দক্ষিণ আফ্রিকা, উগান্ডা, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, জিবুতি, মালি, জামাইকা, কেমেরুন ইত্যাদিসহ অধিকাংশ আফ্রিকান দেশেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিনিয়োগ ও ঋণ প্রদান করেছে। আবার প্রশান্ত মহাসাগরীয় ছোট দ্বীপ যথা পাপুয়া নিউগিনি ছাড়াও টোঙ্গাতেও চীনা বিনিয়োগ রয়েছে।
যদিও সাম্প্রতিক সময়ে চায়নিজ বিনিয়োগ নিয়ে বিভিন্ন দেশে অস্বস্তি এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়েছে। অনেকের মধ্যে মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা কিংবা আফ্রিকার দেশসমূহে তারা যে শর্ত এবং যে ধরনের প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে, তা এসব দেশকে শুধু আর্থ-সামাজিক অনিশ্চয়তার মধ্যেই ফেলবে না, বরং অনেকের নিরাপত্তাসহ সার্বভৌমত্বও হুমকির মধ্যে পড়বে। ঋণ শোধ করতে না পেরে তারা 'ঋণের ফাঁদে' পড়বে। সে প্রেক্ষাপটে অনেক বিশ্লেষকই বাংলাদেশে চায়নিজ বিনিয়োগকে 'ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির' কর্মকান্ডের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন।
সুতরাং বিদেশি বিনিয়োগ গ্রহণের সময় আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য বৃদ্ধি হলেও তা এখনো মূলত মাত্র দুটা সেক্টরে। তা হলো, বৈদেশিক কর্ম-মানব সম্পদ ও পোশাক শিল্পের মতো ঝুঁকিপূর্ণ সেক্টরের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং আমাদের অবকাঠামো উন্নয়নে যতটুকু দরকার তা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে গ্রহণপূর্বক কর্মসংস্থান ও উৎপাদনশীল খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বৈদেশিক ঋণ ও বিনিয়োগ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া আমাদের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বন্ধ করে গৃহীত ঋণ ও বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে।
দেশে বিদ্যমান চীনা বিনিয়োগ এরই মধ্যে বেশ কঠিন সময় পার করছে। চালুর এক বছর পার হতে না হতেই চীনের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে নির্মিত পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ নিয়ে বিপত্তি দেখা দেয়। ডলার সংকটে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি আমদানি নিয়েও মাঝেমধ্যেই বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে পরিচালনাকারী সংস্থাকে। দেশে বিদ্যমান ডলার সংকট বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। আবার চীনের বিদ্যমান ঋণ বিনিয়োগ নিয়েও নানা সময়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকরা। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো এসব ব্যাংক ঋণের ওপর সুদহার ধার্য করে অন্যান্য উৎসের চেয়ে অনেক বেশি। ঋণের বোঝা বাড়ানোর পাশাপাশি তা দেশের বৈদেশিক রিজার্ভেও বড় চাপের কারণ হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং চীনা ঋণ গ্রহণের সময় আর্থ-সামাজিক উন্নতি বনাম ঋণের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকিসহ নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নিরাপদ রাখার মধ্যে কার্যকর সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে। ঋণের শর্ত এবং প্রকল্পগুলো আমাদের প্রয়োজনীয়তার ওপর নির্ধারণ করতে হবে। গৃহীত ঋণের পরিমাণ অবশ্যই আমাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্যের মধ্যে হতে হবে। এসকল বিষয় গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি প্রকল্প গ্রহণের পূর্বে সে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। এসকল বিষয়ে গুরুত্ব দিলে বাংলাদেশের ঋণ ফাঁদে পড়ার সুযোগ থাকবে না বলে বিশ্বাস করি।
লেখক : গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী