বৃহস্পতিবার ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, পৌষ ১২ ১৪৩১

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন লড়াই শুরু, কী প্রভাব পড়বে বিশ্বে?

বিনয় রয়

প্রকাশিত: ১১:১৭, ১২ আগস্ট ২০২৩

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন লড়াই শুরু, কী প্রভাব পড়বে বিশ্বে?

ছবি- সংগৃহীত

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন লড়াই শুরু হতে যাচ্ছে। মাইক্রোচিপ নিয়ে দুই দেশের দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনা বৃদ্ধির মধ্যেই বেইজিং সেমিকন্ডাক্টর তৈরির প্রধান দুটো উপাদান রফতানির ওপর তাদের আরোপ করা বিধি-নিষেধ কার্যকর করতে যাচ্ছে।

বেইজিং প্রশাসনের নতুন এই নীতি অনুসারে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির এই দেশ থেকে কোথাও গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়াম রফতানির জন্য বিশেষ লাইসেন্সের প্রয়োজন হবে।

মাইক্রোপ্রসেসর প্রযুক্তি শিল্পে চীন যাতে খুব বেশি দূর অগ্রসর হতে না পারে সেজন্য এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে চীনের কাছে সেমিকন্ডাক্টর রফতানির ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে ওয়াশিংটন। তার পরেই চীন গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়াম রফতানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে।

বিশ্বব্যাপী যতো গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়াম ব্যবহার করা হয় তার সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী দেশ চীন।জরুরি কাঁচামাল শিল্প সংক্রান্ত জোট ক্রিটিক্যাল র ম্যাটেরিয়ালস অ্যালায়েন্স সিআরএমএ-এর হিসেব অনুসারে সারা বিশ্বে ব্যবহৃত গ্যালিয়ামের ৮০% এবং জার্মেনিয়ামের ৬০% আসে চীন থেকে।গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়ামকে বলা হয় “মাইনর মেটাল”, এর অর্থ এগুলো প্রকৃতিতে এমনি এমনি পাওয়া যায় না। সাধারণত অন্যান্য প্রক্রিয়ার উপজাত হিসেবে এগুলো তৈরি হয়ে থাকে।যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি জাপান ও নেদারল্যান্ডসও চীনের কাছে চিপ প্রযুক্তি রফতানির ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। উল্লেখ্য যে ,সেমিকন্ডাক্টর প্রস্তুতকারী বিশ্বের প্রধান একটি কোম্পানি এএসএমএল নেদারল্যান্ডসে অবস্থিত।

“আমরা দেখতে পাচ্ছি যে বিভিন্ন দেশের সরকার এখন বিশ্বায়নের ধারণা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে,” বলেন বার্মিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কেভিন হারপার, যিনি গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিয়ে গবেষণা করেন।

মাইক্রোপ্রসেসর এবং সোলার সেল তৈরি করতেও জার্মেনিয়াম ব্যবহার করা হয়।গ্যালিয়াম আর্সেনাইড একটি যৌগিক পদার্থ যা গ্যালিয়াম ও আর্সেনিক দিয়ে তৈরি। হাই-ফ্রিকোয়েন্সি কম্পিউটার চিপস তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও লাইট এমিটিং ডায়োডস বা এলইডি লাইট এবং সোলার প্যানেল উৎপাদনেও এই পদার্থটি ব্যবহার করা হয়।বিশ্বের সীমিত সংখ্যক কিছু কোম্পানি ইলকেট্রনিক সামগ্রীতে ব্যবহারযোগ্য নিখাদ গ্যালিয়াম আর্সেনাইড উৎপাদন করে থাকে।

রফতানির ওপর চীনের আরোপ করা বিধি-নিষেধ দীর্ঘ মেয়াদে সীমিত কিছু প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে এরকম একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউরেশিয়া গ্রুপ বলছে, গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়াম রফতানির ক্ষেত্রে চীন শীর্ষ¯’স্হানীয় হলেও, কম্পিউটার চিপস উৎপাদনে যেসব উপকরণের প্রয়োজন সেগুলো উৎপাদনের জন্য বিকল্প উৎস রয়েছে।
তারা বলছে, এজন্য চীনের বাইরেও কিছু স্হাপনা রয়েছে।এক দশক আগে চীন যখন বিরল কিছু খনিজ পদার্থ রফতানির ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করেছিল, তখনও ইউরেশিয়া গ্রুপ প্রতিষ্ঠানটি একই ধরনের বক্তব্য তুলে ধরেছিল।ইউরেশিয়ার হিসাব অনুসারে, ইতোমধ্যে আরও কিছু রপ্তানিকারক দেশের আবির্ভাব ঘটেছে এবং এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে দুষ্প্রাপ্য খনিজ পদার্থ সরবরাহের ক্ষেত্রে চীনের আধিপত্য ৯৮% থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৬৩%

ইউরেশিয়ার একজন পরিচালক আন্না অ্যাশটন বলেন,“গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়ামের জন্য বিকল্প উৎসের আরও বিকাশ ঘটবে বলে আমরা আশা করতে পারি। একইসাথে এসব পণ্যের রিসাইক্লিং প্রক্রিয়াও আরও জোরালো হবে। বিকল্প উৎসের সন্ধানেও তৎপরতা আরও বৃদ্ধি পাবে,”

তিনি আরো বলেন,‘এটা যে শুধু চীনের রফতানি বিধি-নিষেধের ফলেই হবে তা নয়। ক্রমবর্ধমান চাহিদা, ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত প্রতিযোগিতা ও অবিশ্বাস- এসবের ফলেও এমনটা ঘটবে,”।

গত বছরের অক্টোবর মাসে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল যেসব কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সফটওয়্যার কিম্বা উপকরণ ব্যবহার করে চীনের কাছে চিপ (এগুলো বিশ্বের যেখানেই তৈরি করা হোক না কেন) রফতানি করবে তাদেরকে লাইসেন্স নিতে হবে।

ওয়াশিংটনের এই নিয়ন্ত্রণ আরোপের পর চীনের পক্ষ থেকে প্রায়শই অভিযোগ করা হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র “প্রযুক্তি খাতে একক আধিপত্য” প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে।সাম্প্রতিক কালে চীন আমেরিকার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত এরোস্পেস কোম্পানি লকহিড মার্টিনের মতো কোম্পানির ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে।এর পাশাপাশি পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের সরকার এসব খনিজ পদার্থ ও তৈরি পণ্যের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর ওপরেও জোর দিয়েছে।

এসব খনিজ পদার্থের বিকল্প উৎস খুঁজে বের করা এবং ব্যবহারের জন্য গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়ামের মতো উপাদানকে প্রস্তুত করতে আরও কয়েক বছরের সময় প্রয়োজন।বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে এসব সম্পদ ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলে - যা চীন ও যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে করেছে – তা সারা বিশ্বের পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

রফতানি নিয়ন্ত্রণের এই বিধি-নিষেধ যে এখনই এই শিল্প খাতে বা ভোক্তা পর্যায়ে বিপর্যয় ডেকে আনবে তা নয়, কিš‘ বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই প্রবণতা কোন দিকে যা”েছ সেদিকে নজর রাখা জরুরি।
“সাধারণ মানুষ নিজেদেরকে গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়ামের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারবে না। তবে একটা গাড়ির দাম কতো হবে এবং পরিবেশের ক্ষতি করে না এরকম প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হলে কতো খরচ পড়বে- এসব বিষয় নিয়ে তারা ঠিকই চিন্তা করেন,” বলেন তিনি।
“কখনো কখনো দূরের দেশে বিমূর্ত কিছু নীতি গ্রহণ করা হয়, আমাদের জীবনের ওপর যার সত্যিই বড় ধরনের প্রভাব পড়ে থাকে।”
    


সম্পাদনা-রীতা আক্তার