শুক্রবার ১৮ অক্টোবর ২০২৪, কার্তিক ৩ ১৪৩১

প্রবাসে বড়দিন

মো:হাসিবুর রহমান

প্রকাশিত: ১২:২০, ২১ ডিসেম্বর ২০২২

আপডেট: ১৩:১৮, ২৮ ডিসেম্বর ২০২২

প্রবাসে বড়দিন

ছবি:সংগৃহীত

সাত-সমুদ্র-তেরো নদী পেরিয়ে গিয়েছিলাম স্বপ্নের দেশ যুক্তরাজ্যে। সেই ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসে।দুবাই বন্দরে বিরতি দিয়ে প্রায় ১৩-১৪ ঘন্টা বিমানের ভিতরে বন্ধী থেকে অবশেষে হিথ্রো বিমান বন্দরে নেমে চারিদিকে এত আলোক-সজ্জা দেখে অবিভূত হয়ে পড়েছিলাম। তবে ক্রিসমাস-ট্রি আর সান্টাক্লজের ছবি দেখে মনে হলো এটা বড়দিনের মাস অথাৎ খ্রিষ্টের মাস । সেবারই জীবনে প্রথম প্রবাসে এত ব্যাপকভাবে বড়দিন পালন করার আনন্দ-উৎসব উপলব্ধী করার সুযোগ হয়েছিলো। ছোট বেলায় ইংরেজী কোর্স শেখার জন্য মিরপুরে অবস্থিত ‘Seventh Day Adventist Church of Bangladesh’ যাওয়ার সুবাদে সেখানে আমার একজন খ্রিষ্টান বন্ধু হয়েছিলো। সেই সুবাদে প্রতিবছরই বড়দিন এলে বন্ধুর বাসায় দাওয়াতে যেতাম।

ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ ‘ক্রিসমাস-ডে’ খ্রিষ্টীয় ধর্মাবলীদের জন্য আমাদের ইদের মতো উৎসব-আনন্দের দিন। প্রাকৃতিভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে প্রতিবছর ২৩ ডিসেম্বর থেকে দিন ক্রমশ বড় এবং রাত ছোট হতে আরম্ভ করে সেজন্য ২৫ ডিসেম্বর যিশু খ্রিষ্টের জন্মোৎসব উৎসবটিকে বাংলায় বড়দিন হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। অন্যদিকে, খ্রিষ্টীয় ধর্ম ও দর্শনের আবেগে দিক থেকে যিশুর জন্মদিনটাই জীবন দর্শনের বিশালতার মর্ম থেকে এ দিনটিকে বড়দিন হিসেবে বিবেচিত হয়। উপাখ্যান অনুসারে জানা যায়, স্বামী জোসেফের সাহচার্যে বেথলেহেম শহরে উপস্থিত হয়ে মেরি একটি আস্তাবলে গবাদি পশু পরিবৃত অবস্থায় যিশুর জন্ম দেন। যিশুর জন্মের পর বেথলেহেমের তারার সাহায্যে পথ চিনে তাঁকে দর্শন করতে আসা বালথাজার, মেলকোয়ার ও ক্যাসপার নামক তিন জ্ঞানী ব্যক্তির কথাও উল্লেখিত। সেই থেকে বড়দিন উৎসবের অন্যতম উপাদান গুলো হলো গৃহসজ্জা, একে-অপরকে পছন্দের উপহার আদান-প্রদান ও খ্রিষ্টের জন্মসংক্রান্ত নাটক অভিনয় এবং ক্যারোল গাওয়ার প্রথা বিদ্যমান। তাছাড়া,বড়দিনের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় চরিত্র হল টুপি, দাঁড়ি আর লাল পোশাক পরিহিত শিশুদের উপহার প্রদানকারী পৌরাণিক ‘সান্টাক্লজ’।

সান্টাক্লজ নামটি ডাচ সিন্টারক্লাস নামের অপভ্রংশ; যার সাধারণ অর্থ সেন্ট নিকোলাস। শিশুদের কাল্পনিক চরিত্রে প্রিয় সান্টাক্লজ কাছ থেকে উপহার পাওয়ার জন্য তারা সারা রাত অপেক্ষা করে। সান্টাক্লজ তাদের মনের বাসনা অনুযায়ী খেলনা বা উপহার সামগ্রী প্রদান করে শিশুদের মুখে হাসি ফুটিয়ে বড়দিনকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।ধর্মীয় অনুষ্ঠান যে এত প্রাণবন্ত ও উৎসব মুখর হয় তা এদেশে না এলে জানতেও পারতাম না। বিভিন্ন শপিংমলের দরজায়, কাচের উইন্ডোতে ৫০%, ৬০% এমনকি ৭০% পর্যন্ত মূল্য হ্রাস লেখা আছে। একটু খতিয়ে দেখার জন্য যুক্তরাজ্যের সমানধন্য শপিং সেন্টার হ্যারডস গিয়ে আমার জন্য কিছু কেনার জন্য গিয়ে দেখলাম সেখানেও ৫০%, হ্রাসকৃত মূল্যে বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। হ্যারডস এর মতো দামি শপিংমলে অর্ধেক দামে কিনতে পেরে এত আনন্দ পেয়েছিলাম তা আজও মনে পড়ে। তাছাড়া লক্ষ্য করলাম শুধু জামা-কাপড়ের দাম নয় আসবাবপত্র,ফল-চকলেট ইত্যাদি সব ধরনের দ্রব্যের দাম অর্ধেক করে দেয় শপিং মলের সব দোকানে। এমনকি খাদ্যের দামও অর্ধেক করে দেয় ডিসেম্বরের পুরো মাস জুড়ে।

ভালো কথা আমার এক বন্ধু গ্রেড ব্রিটেনে পড়ালেখা করতে এসে এখানে লন্ডনী মেয়ের প্রেমে পড়ে বিয়ে করে এখানেই বসবাস করে, তার ঠিকানা দেশ থেকে নিয়ে এসেছিলাম। অনেক খোঁজাখুজির পর জনি ভাইকে খুঁজে পাওয়াতে ভিন দেশেও আমার সময় কেটে ছিল অনেক আনন্দে। সে ছিলো আমার এক বছরের সিনিয়র। আমি পড়তাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে আর সে শেরেবাংলা কৃষি কলেজে। দেশে থাকতে তাঁর সাথে এমন কোন সখ্যতা ছিলো না। কেমন আছেন, ভালো আছিস খোঁজ খবর নেওয়ার সম্মোধনের মধ্যে সীমাবদ্ধতা ছিল। বিদেশের মাটিতে জনিকে পেয়ে মনে হয়েছিল সে যেন আমার অনেক আপন একজন। জনির কাছ থেকে যুক্তরাজ্যের অনেক বাস্তব ঘটনা জেনেছিলাম আর তার জনির সাথে যুক্তরাজ্যের অনেক জায়গায় ভ্রমণের সুযোগে হয়েছিল। ছুটির একদিন আমাকে নিয়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে স্কটল্যান্ডের গভীরতম লেক লকনেস দেখতে নিয়ে গিয়েছিল। স্কটল্যান্ডের মানুষ ওটাকে মনস্টার লেক বলে। লেকে প্রবেশের মুখে একটা যাদুঘর তৈরি করে রেখেছে, সেটাতে ব্যটারীর তৈরি মনস্টার আছে একুরিয়ামে ও লেকের ভিতরে কাল্পনিক মনস্টারের অনেক ছবি আছে। লেকের পাড়ে ওখানকার বিখ্যাত ব্যাগ পাইপারের সাথে ছবি তুলে রওনা দিয়েছিলাম ‘বেন-নেভিস আর গ্লেন-নেভিস’ পাহাড় দেখতে।

দেখেছিলাম এডিনবরার রাজকীয় ক্যাসেল।সেই সব স্মৃতি আজও মনে পড়ে।বড় দিনের দাওয়াতে জনির বাসায় গিয়ে অবাক হয়েছিলাম। একজন ব্রিটিশ সাদা মেয়ে আমি আসবো জেনে আমার প্রিয় খাবার ইলিশ মাছ ভাজা, গরুর মাংসের ভুনা আর খিচুড়ি রেঁধেছে। প্রবাসে বাংলা খাওয়া পেয়ে আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে মনভরে খেয়েছিলাম। তাদের এক ছেলে দুই মেয়েদের জন্য চকোলেট আর ফল নিয়ে গিয়েছিলাম। বাচ্চারা উপহার হিসেবে খাওয়ার চেয়ে বেশি পছন্দ করে বড় দিনের কার্ড,খেলনা ও ফুল। তাই জনির ছোট মেয়ে ম্যাগন বলেই ফেলেছিলো আঙ্কেল তুমি কি আমার জন্য ক্রিসমাস কার্ড আনোনি? আমি সরি বলে লজ্জা পেলাম। জনি আমাকে বোঝালো এদেশে দামি উপকারের চেয়ে মানুষ আন্তরিকভাবে একটা ফুল বা কার্ড পেলেই বেশি আনন্দিত হয়। জনির বাসায় গিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ দেখেছিলাম। ঘরের ভিতরে ছোট্ট একটা ক্রিসমাস ট্রি আলোক সজ্জায় সজ্জিত হয়ে ঘরের শোভা বর্ধন করছে। অপরদিকে দেখতে পেয়েছিলাম বাড়ির ভিতরে ছোট্ট একটা রুমিকে বানিয়েছে নামাজের স্থান। সেখানে রয়েছে জায়নামাজ, তসবিহ, টুপি ইত্যাদি। দুইটি ভিন্ন ধর্মের মানুষের সহাবস্থান দেখে আমি সত্যিকারেই মুগ্ধ হয়েছিলাম। যতদিন ইংল্যান্ডে ছিলাম ওদের দুজনকে পারিবারিকভাবে সুখী মানুষ হিসেবে দেখেছিলাম। আমার স্মৃতিতে অনন্যদিন ২০০০ সালের ‘মিলিনিয়াম ডে’, সেদিন পুরো শহর সেজেছিলো অপরূপ সাজে। তাই সেবছর বড়দিনও সেজেছিল অনন্য রূপে। সমস্ত রাস্তা-ঘাট, বাড়ি-ঘর, অফিস-আদালত ছিল আলোকসজ্জায় সজ্জিত। কেননা, কয় দিন পরেই একই সাথে পালিত হবে মিলিনিয়াম ডে ও থার্টি ফার্স্ট নাইট, ১৯৯৯ কে বিদায় দিয়ে নতুন বছরের সাথে নতুন শতাব্দীতকে স্বাগতম জানানো হবে।

বড়দিন উপলক্ষ্যে অনেক দেশের ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বাৎসরিক পরিকল্পনা করে থাকে। প্রায় সকল পাইকারি বাজার ও খুচরা দোকানে এই উপলক্ষে ব্যবসাবাণিজ্যের প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। দেশের সব মানুষ তাদের চাহিদামত পছন্দের উপহার, সাজসজ্জার সামগ্রী ও অন্যান্য দ্রব্যাদি প্রচুর পরিমাণে কেনে বলে নতুন নতুন উৎপন্নদ্রব্য বাজারে ছাড়া হয়। ধনী-গরিব সকলের ক্রয়ের সুবিধার্থে শপিংমলগুলোতে প্রায় সকল সামগ্রী অর্ধেক দামে বিক্রি করে। তাছাড়া লক্ষ্য করা যায় শুধু জামা-কাপড় নয়, আসবাবপত্র,ফল-চকলেট ইত্যাদি, সব ধরনের দ্রব্যের দাম অর্ধেক করে দেয় শপিং মলের সব দোকানে। সেই সাথে খাদ্যের দামও অর্ধেক করে দেয় ডিসেম্বরের পুরো মাস জুড়ে।
 
যে ক‘বছর গ্রেড ব্রিটেনে ছিলাম ডিসেম্বর মাসে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য অর্ধেক দামে কেনার সুযোগে সকলের সাথে আমিও কেনা-কাটা করতাম আর চিন্তা করতাম আমাদের দেশে ধর্মীয় রোজার মাসে ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার লোভে খাদ্যদ্রবসহ সকল পন্যের দাম বৃদ্ধি করে দেয়।একবার রোজার মাসে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ছিলাম, মামা বাড়ির পাশে বসবাসরত দিনমজুরের রোজার মাসের কথা শুনে কান্না পেয়েছিলো তা মনে পড়লে আজও চোখে পানি আসে। সে বলেছিলো, রোজ শেষে শুধু মুড়ি-পানি খেয়ে ইফতারি করে।আর শেষ রাতে সেহরির সময় শাক-পাতা,কোনদিন ছোট মাছ রান্না করে ভাত খেয়ে সারা মাস রোজা রাখে। আমার সামর্থ্য মতো কিছু টাকা দিয়ে বলেছিলাম ভালো কিছু কিনে খেয়ে রোজা রেখেন। সামান্য টাকা দিয়ে আর ক’দিন চলবে? আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা কি ধর্মীয় রোজার মাসের কথা বিবেচনায় রেখে মুনাফা একটু কম করে খাদ্য দ্রব্যের  দাম অর্ধেক করে দিতে পারে না?

(লেখক: মো: হাসিবুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্কমর্কতা ও পিএইচডি গবেষক)