শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, পৌষ ৭ ১৪৩১

সেনাপ্রধানের ভারত-চীন সফর সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করবে

হীরেন পন্ডিত

প্রকাশিত: ১৯:৪৯, ১৫ অক্টোবর ২০২৩

সেনাপ্রধানের ভারত-চীন সফর সম্পর্কে  নতুন মাত্রা যোগ করবে

হীরেন পন্ডিত, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

সম্প্রতি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ, এসবিপি (বার), ওএসপি, এনডিইউ, পিএসসি, পিএইচডি দুই দেশের সরকারের আমন্ত্রণে ভারত ও চীন সফর করেন। চীন সফরকালে সেনাপ্রধান ১৯তম এশিয়ান গেমস্ এর উদ্বোধনসহ বিভিন্ন গেমস্ অ্যান্ড স্পোর্টস ইভেন্ট পর্যবেক্ষণসহ বিভিন্ন দেশের ন্যাশনাল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও মহাসচিবগণের সাথে মতবিনিময় করেন। সফরকালে তিনি বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে চীনের হ্যাংজো শহরে অনুষ্ঠিত ১৯তম এশিয়ান গেমস এর উদ্বোধন করেন। তিনি বিভিন্ন গেমস অ্যান্ড স্পোর্টস ইভেন্ট পর্যবেক্ষণ করেন। এছাড়াও সেনা প্রধান বিভিন্ন দেশের ন্যাশনাল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও মহাসচিবদের সাথে মতবিনিময় করেন।

চীন সফর শেষে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধানের আমন্ত্রণে জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ ২৫ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ইন্দো-প্যাসিফিক আর্মিস চীফ’স কনক্লেভ (আইপিএসি) সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এই সম্মেলনের লক্ষ্য হচ্ছে মূলত বন্ধু ভাবাপন্ন দেশসমূহের স্থলবাহিনীগুলোর মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে পারষ্পরিক আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি, পেশাদারী সম্পর্ক উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা। এছাড়াও এই সম্মেলনে বিভিন্ন বন্ধুপ্রতিম দেশের সেনাবাহিনী প্রধান পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ পারষ্পরিক বৈঠকে অংশ গ্রহণ করে নিজেদের মধ্যে প্রশিক্ষণ সহযোগিতাকে জোরদার করার ক্ষেত্রে সম্মিলিতভাবে কাজ করার ব্যাপারে আলোচনা করেন।

ভারত সফরকালে সেনাপ্রধান ভারতের চেন্নাইয়ে অবস্থিত অফিসার্স ট্রেনিং একাডেমির কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারদের পাসিং আউট প্যারেডে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে প্যারেডের অভিবাদন গ্রহণ করে। এ ছাড়া তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেনএরপর ভারত সফরকালে তিনি ভারতের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা পরিষদ সচিবালয়ের সামরিক উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) বিনোদ জি খান্ডারে, প্রতিরক্ষা সচিব অজয় কুমার, চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল বিপিন রাওয়াত, ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ মুকুন্দ নারাভানে ও বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল রাকেশ কুমার সিং ভাদুরিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ ছাড়াও, তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫০ স্বতন্ত্র প্যারাসুট ব্রিগেড, ওয়ারগেমিং ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, ডিফেন্স ইমেজ প্রসেসিং অ্যান্ড এনালাইসিস সেন্টার ও ভারতের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ (এনডিসি) পরিদর্শন করেন।

সফরের শুরুতে সেনাবাহিনী প্রধান দিল্লি ও আগ্রায় বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা পরিদর্শন করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি আগ্রায় অবস্থিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫০ স্বতন্ত্র প্যারাসুট ব্রিগেড পরিদর্শন করেন। সেখানে ওই ব্রিগেডের সক্ষমতা, কার্যক্রম ও প্রশিক্ষণ সম্পর্কে সেনাপ্রধানকে ধারণা দেওয়া হয়। এই ব্রিগেডটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সদস্য হিসেবে সর্বপ্রথম টঙ্গী হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে।

সেনাপ্রধান ভারতের ওয়ারগেমিং ডেভেলপমেন্ট সেন্টার ও ডিফেন্স ইমেজ প্রসেসিং অ্যান্ড এনালাইসিস সেন্টার পরিদর্শনকালে প্রতিষ্ঠান দু’টির কার্যক্রম ও কারিগরি বিষয় সম্পর্কে অবগত হন এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো নিয়ে আলোচনা করেন। পরে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা পরিষদ সচিবালয়ের সামরিক উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) বিনোদ জি খান্ডারের সঙ্গে সাক্ষাতে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন সেনাপ্রধান। ভারতের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, পররাষ্ট্র নীতি ও নিরাপত্তা বিষয়ক আয়োজিত এক সেমিনারে এনডিসি কোর্স মেম্বার ও অনুষদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ। সেমিনার শেষে উন্মুক্ত আলোচনায় তিনি এনডিসি কোর্স মেম্বারদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।

ভারত সফরের শেষ দিনে সেনাপ্রধান ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়ালে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। সেখানে তিনি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে মিত্র বাহিনীর জীবন উৎসর্গকারীদের নাম খচিত স্থান ঘুরে দেখেন এবং আলাদাভাবে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করেন। পরবর্তীতে তিনি সাউথ ব্লকে পৌঁছালে তাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। গার্ড অব অনার শেষে তিনি ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মনোজ মুকুন্দ নারাভানে ও প্রতিরক্ষা সচিব অজয় কুমারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎ শেষে তাকে ভারতের নিরাপত্তা চিন্তাধারা ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদন বিষয়ে দুটি পৃথক ব্রিফিং প্রদান করা হয়।

বৈঠক সমাপনান্তে সেনাবাহিনী প্রধান ভারতের বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল রাকেশ কুমার সিং ভাদুরিয়া ও চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল বিপিন রাওয়াতের সঙ্গে তাদের কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন। পরবর্তীতে তিনি ভারতের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গে তার কার্যালয়ে সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় করেন।

ভারত সফরে দেশটির চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ, প্রতিরক্ষাসচিব, পররাষ্ট্রসচিবসহ অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সেনাপ্রধানের সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এসব সাক্ষাৎকালে তাঁদের মধ্যে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়ন ও পারস্পরিক সহযোগিতার বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। সফরে সেনাপ্রধান ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পরিদর্শন করেন।

এছাড়াও, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ইন্দো-প্যাসিফিক আর্মিস চিফস কনক্লেভ (আইপিএসি) সম্মেলনে তিনি বিভিন্ন দেশ হতে আগত সেনাবাহিনী প্রধানসহ উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাগণের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে স্ব স্ব স্থল বাহিনীসমূহের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি, পেশাদারি সম্পর্কন্নোয়ন, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার, সংঘাতপূর্ণ সমস্যাসমূহ মোকাবিলা, যৌথ প্রশিক্ষণ এবং স্থল বাহিনীসমূহের আধুনিকায়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন।

আলোচনায় উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পেশাগত দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার মাধ্যমে কঠোর অনুশীলন, পেশাগত দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার সমন্বয়ে নিষ্ঠা এবং আন্তরিকভাবে সাথে দেশের সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ জাতীয় যে কোন প্রয়োজনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে সদা প্রস্তুত রয়েছে। তাছাড়াও আমাদের সেনাবাহিনী দেশের যে কোন দুর্যোগ মোকাবেলায় জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং বিভিন্ন বৈদেশিক মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের আত্মত্যাগ, কর্তব্যনিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছে সম্মান ও মর্যাদা, যা বহিঃর্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে অত্যন্ত উজ্জ¦ল করেছে। আবহমান কাল থেকেই যুদ্ধের ময়দানে জাতীয় মর্যাদার প্রতীক ‘পতাকা’ বহন করার রীতি প্রচলিত আছে। পতাকা হল জাতির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, সম্মান এবং মর্যাদার প্রতীক। তাই পতাকার মান রক্ষা করা সকল সেনা সদস্যদের পবিত্র দায়িত্ব।

সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৯৮ সালে ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ’ এবং ‘মিলিটারি ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি’, ১৯৯৯ সালে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিং’ এবং ‘আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজ’ প্রতিষ্ঠা।

প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন যুগোপযোগী সামরিক বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করা হয়েছে। দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে সিলেটে ১৭ পদাতিক ডিভিশন, রামুতে ১০ পদাতিক ডিভিশন এবং বরিশালে ৭ পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নতুন ৩টি ব্রিগেড এবং ছোট বড় ৫৮টি ইউনিট প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।

সেনাবাহিনীতে নতুন কম্পোজিট ব্রিগেড ও প্যারা কমান্ডো ব্রিগেড যুক্ত করা হয়েছে। তাছাড়াও অত্যাধুনিক এমবিটি-২০০০ ট্যাংক, অ্যাম্ফিবিয়াস ট্যাংক ভিটি-৫, এমএলআরএস রেজিমেন্ট, মর্টার রেজিমেন্ট, সেল্ফ প্রোপেল্ড রেজিমেন্ট, এম.আই.-১৭১ এস.এইচ. হেলিকপ্টার ও কাসা সি-২৯৫ ডবিøউ এর মত অত্যাধুনিক পরিবহন বিমান, অত্যাধুনিক ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র মেটিস-এম-১, বিমান বিধ্বংসী মিসাইল এফএম-৯০ এবং আধুনিক পদাতিক সৈনিক ব্যবস্থা সেনাবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে।

জাতীয় নিরাপত্তা ও ঝুঁকি মোকাবেলায় এই মেকানাইজড ইউনিটসমূহের সংযোজন এক নতুন মাত্রা যোগ করবে ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক ভারত ও চীন সফর এসব বৈঠকে স্ব-স্ব স্থল বাহিনীগুলোর মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি, পেশাদারি সম্পর্কন্নোয়ন, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার, সংঘাতপূর্ণ সমস্যাগুলো মোকাবিলা, যৌথ প্রশিক্ষণ এবং স্থল বাহিনীগুলোর আধুনিকায়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করার বিষয়গুলো বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে আরো সমৃদ্ধ করবে এটাই সবার প্রত্যাশা।

হীরেন পন্ডিত, প্রাবন্ধিক ও গবেষক


--