রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ভাদ্র ২৩ ১৪৩১

কোরবানির ঈদ এবং আমার বাবা

জিনাত নাজিয়া

প্রকাশিত: ১৭:০৯, ২৬ জুন ২০২৩

কোরবানির ঈদ এবং আমার বাবা

ছবি- সংগৃহীত

বাবাকে যখন ঠিকভাবে উপলব্ধি করতে শিখি তখন আমার বয়স সম্ভবত সাত অথবা আট হবে। আমার এখনো মনে আছে সেই সময় একবার কোরবানির ঈদ হয়েছিল খুব বর্ষার সময়ে। বাবা খুব সুন্দর একটা খাসি ছাগল কিনে এনেছিলেন।  ছাগলটা দেখতে এতো সুন্দর ছিলো, দেখে আমার খুব মায়া হলো। আহারে! এতো সুন্দর প্রানীটাকে জবাই করে দিবে। কেন যেন খুব কষ্ট হচ্ছিলো আমার।
 
ঈদের এখনো বাকি এক সপ্তাহ হবে। মায়ের কিচেন সম্রাট মতলব নামের ছেলেটার দায়িত্ব পরলো এটার দেখাশোনা করার। খুব ছোট ছিলাম বলে কিনা জানিনা, এই যে এতো এতো গরু ছাগল জবাই করার ভয়াবহ দৃশ্যটা আমার মনের ভিতর একটা দু:খ  কাজ করতো। আসলে আমি যে কোনো রক্ত দেখলেই ভয় পেয়ে যাই। সারা শরীর আমার কাঁপতে থাকে। আরও ছোট বেলায়, মানে আমি তখন মাত্রই হামা দেয়া শিখেছি। কিছুই বুঝিনা। মায়ের কাছে শুনেছি, একবার বাবা নাকি আমাকে কোলে নিয়ে গরু জবাই করা দেখতেছিলেন। আমি চিৎকার দিতে দিতে বাবার কোলেই নাকি অজ্ঞান  হয়ে গিয়েছিলাম। অনেকদিন অসুস্থ ছিলাম। বড় হওয়ার পর অবশ্য এই কোরবানির ব্যাপারটা বাবা আমাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তী জীবনে অবশ্য এই ব্যাপার টা আমাকে কষ্ট দিত ঠিকই, কিন্তু এই প্রানগুলো সব সরাসরি আল্লাহর কাছে চলে যাবে অর্থাৎ এদের আত্ত্বা বেহেশতে চলে যাবে, এটা ভেবে  তেমন আর খারাপ লাগতোনা। তারপর আছে গরীবদের মাঝে মাংস বিতরন, আত্ত্বিয়- স্বজনদের মাংস দেয়া এইগুলো সবই সওয়াবের কাজ। আসলে ছোট বেলায় মানুষ অনেক কিছুই বুঝেনা, যেটা বড়বেলায় এসে ক্লিয়ার হয়ে যায়। এখন যেমন সবার ঘরে ঘরে টিভি আছে, তখন ঘরে ঘরে রেডিও, ক্যাসেট প্লেয়ার ছিলো। এইগুলায় যখন গান বাজতো, আমি মনে করতাম সিংগারকে এই যন্ত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হতো। এখন মনে হলে নিজেরই হাসি পায়।

 যাই হোক, ঈদের আর মাত্র দু' দিন বাকি। আমাদের ছাগল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। বাবার মাথা খারাপ অবস্থা। মা ভীষণ অস্থির হয়ে আছেন। সবাই চিন্তিত। বাবা কেন যেন আমার দিকে একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাছিলেন। ভয় পেয়ে গেলাম। ধরা খাব নাতো? মনে মনে হাজার বার আল্লাহকে ডাকলাম, যেন এ যাত্রায় খাসিটা বেঁচে যায়। আমার যা হয় হোক, একটা নিরীহ প্রাণী তো বেঁচে যাবে। হঠাৎ কোথা থেকে বাবা এসে আমার কান ধরে বললেন, " তুই করেছিস। " হতবম্ভ হয়ে গেলাম, বাবা কিভাবে বুঝতে পারলেন?   ভয়ে হাত পা কাঁপতে ছিলো, কিন্তু কিছুতেই স্বীকার করলাম না। অনর্গল মিথ্যা বলে যাচ্ছিলাম। হাল ছেড়ে দিয়ে বাবা চারদিকে লোক পাঠালেন। আমি আর  বাবার একান্ত বাধ্যগত  মতলব নামের ছেলেটা সহ ছাগল খুঁজতে বেরিয়ে পরলাম । মনে মনে বললাম, আল্লাহ ছাগলটা যেন এ যাত্রা বেঁচে যায়। কিন্তু সেই সময় অন্য কেউ ছাগল টা খেয়ে ফেলতে পারে, এটা একদম মাথাই আসেনি।

প্রায় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো। গাছের পাতায় ধুলোর আস্তরন জমে পাতাগুলো বিবর্ন হয়ে আছে। মনে হলো টিপটিপ বৃষ্টি ও হচ্ছে। আবার সূর্য ও যেন পলকহীন তাকিয়ে আছে গোধূলি বেলায়। চারদিকে আলো আঁধারির এমন লুকোচুরি খেলার মধ্যেই হঠাৎ একটা ছাগলের ডাক শুনলাম যেন। ভয় পেয়ে গেলাম আমি। এদিক ওদিক তাকাতেই দেখলাম ছাগলের গলার দড়ি ধরে আমাদের সুপারম্যান মিস্টার মতলব সাহেব
বিজ্ঞ্যের মতো এক হাসি দিয়ে বললো, এই যে দেখেন আফা ছাগল পাইয়া গেছি, শিগগিরই বাড়িতে চলেন, চাচাকে খবর দেই। আমার খুব মন খারাপ হলো। ছেড়ে দেয়ায় সময় ওর কানের কাছে এতো করে বুঝিয়ে বললাম,
' যত দূরেই পারিস চলে যাবি, তা না হলে বাবা তোকে মেরে ফেলবে।' বোকা প্রাণী টা বুঝতেই পারলোনা আগামীকাল ওর জন্য কি ভয়াবহ একটা পরিনতি অপেক্ষা করছে। বেচারা! ছাগল। শেষ চেষ্টা হিসাবে
মতলব কে অবাক করে দিয়ে বললাম,
" ভালো করে দেখতো, মনে হয় এটা অন্য কারুর ছাগল হবে।"
" আরে না না আফা কি কন, হইতেই পারে না। এই দড়ি দিয়াই আমি ছাগল ডারে বাইন্ধা রাখছিলাম। এইডাই আমাগো ছাগল।" ও আমার কথার তেমন গুরুত্ব না দিয়ে বাড়ির পথ ধরলো। খুব মন খারাপ হলো আমার।

ছাগল ফিরে পেয়ে সবাই খুব খুশি। শুধু বাবাকে কেন যেন বেশ গম্ভীর মনে হলো। সম্ভবত আমার কি ভয়ানক শাস্তি হতে পারে, এটা ভেবেই ভয় পাচ্ছিলেন। একটু ভয় ভয় লাগছিলো আমার ও, কোন কঠিন নিষেধাজ্ঞা জারি হবে  আল্লাহই জানে।
আমার মা ছিলেন অনেক কঠিন প্রকৃতির। মতলবকে বললেন,
" ঘরের থেকে আর একটা দড়ি নিয়ে আয় তো।"
" আর একটা দিয়া কি হইবো চাচি, এই দড়ি দিয়াই শক্ত কইরা বাইন্ধা রাখব  ছুটতে পারবনা।"
মায়ের কঠিন চোখের দিকে তাকিয়ে বাধ্য ছেলের মতো  এক দৌড়ে গিয়ে দড়ি এনে মায়ের হাতে দিল। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই মা আমাকে শক্ত করে একটা গাছের সাথে বেঁধে ফেললো এবং খুব রাগের সাথে বললো,
" তুই কি মনে করেছিস আমি কিচ্ছু বুঝিনাই। সারারাত এখানে থাকবি, এটাই তোর শাস্তি। বড় হয়েছিস তাও বুঝতে পারছিস না। ছাগল যদি আজকে পাওয়া না যেত তোর বাবা আবার কোরবানির জন্য ছাগল কিনতে পারত? বাবাকে রেখে ছাগলের জন্য তোমার মায়া বেশি হয়ে গেছে, তাইনা? "
আমি চুপচাপ নিচের তাকিয়ে অনবরত ভাবছিলাম, বাবার প্রতি মায়ের কঠিন হৃদয়ের উল্টো পিঠে একটা মায়াবী কোমল ভালোবাসা লুকিয়ে আছে। যেটা ছাগল টার জন্য তো নেইই, নিজের মেয়ের জন্য ও নেই, থাকলে কি আর এভাবে সন্তানকে কোনো মা রাতের বেলা গাছের সাথে বেঁধে রাখে?
মায়ের কঠিন দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে কেউ আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহস পেলো না। সবাই যার যার মতো ঘরে চলে গেলো, এমন কি বাবা ও এখানে থাকার দু:সাহস দেখালেন না। রয়ে গেলাম শুধু আমি আর বেচারা ছাগল।

সন্ধ্যা সাতটার মতো হবে হয়তো বা। কিন্তু  দৌত্যের মতো বিশাল বিশাল গাছগুলোর ছায়ায় কেমন একটা ভৌতিক পরিবেশের আবহ নেমে এলো। মায়ের মতো মশাগুলো ও মনে হয় আজ আমাকে শাস্তি দেয়ার জন্য দল-বল নিয়ে ছুটে এসেছে। কি করা যায় ভাবতে ভাবতেই কখন যেন বাবা এসে আমার বাঁধন খুলতে খুলতে বললেন,
" খুব ভয় পেয়েছিস? আমি ও খুব ভয়ে ছিলাম, যদি ছাগল টা খুঁজে না পেতিস  তখন কি হতো। এখন চল গোছল করে খাবি। আর কখনো এ রকম করবিনা।"
"কিন্তু...  "
" কিচ্ছু বলবেনা, তোর মা ই আমাকে পাঠিয়েছে।" বুঝতে কষ্ট হলো না যে মায়ের পারমিশন ছাড়া এটা কখনোই  সম্ভব না। আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না বাবাকে । মা- বাবার ভালোবাসা কি জিনিস সম্ভবত সেটা বুঝেই আমার খুব কান্না আসতে ছিলো। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে পাশে থাকা ছাগলের দড়ি খুলতে লাগলাম। বাবা বললেন,
" ওকে ও গোছল করাবি নাকি ?"
 কাঁদ কাঁদস্বরে বললাম,
"না বাবা, ওকে মশার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ঘরে নিয়ে যাচ্ছি।"
বাবা আমার কথায় মনে হলো একটু হাসলেন। হয়তো ভাবছেন- কি পাগল মেয়েরে বাবা। সেদিনই প্রথম বাবা আমাকে আদর করে পাশে বসিয়ে আমাদের  কোরবানি সম্পর্কে সব বুঝিয়ে বললেন। তারপর থেকে আমার আর কখনো এ রকম সমস্যা হয়নি।
এই হচ্ছেন আমার বাবা। সন্তান হাজার অন্যায় করলে ও সেটা সুন্দর করে বুঝিয়ে পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারতেন। সেদিনই প্রথম বুঝতে পারলাম আমার বাবার বুকে সন্তানের জন্য কত মায়া।

আজ আর সেই বাবাও নেই, মায়াও নাই। মাঝেমধ্যে এখনো স্মৃতিরা শাখা প্রশাখা বিস্তার করে হামলা করে মনের গভীরে।  কখনো সখনো ইচ্ছে করে স্মৃতির ঘরে বড় একটা তালা লাগিয়ে চাবিটা কোনো গভীর জংগলে ফেলে দেই, যেখান থেকে ওটাকে আর কোনো দিন খুঁজে  পাওয়া যাবেনা।