রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ভাদ্র ২৩ ১৪৩১

আমার মায়ের শেষ দিনগুলো : মাকে মনে পড়ে

রোজালিন ডি কস্তা

প্রকাশিত: ১২:১৫, ১৫ এপ্রিল ২০২২

আমার মায়ের শেষ দিনগুলো : মাকে মনে পড়ে

লেখক

আজ ১০ই মার্চ বুধবার। এইদিন আমাদের সবাইকে শোকসাগরে ভাসিয়ে দিয়ে আমাদের স্নেহময়ী আদরিনী মা আমাদের কাছ থেকে চির বিদায় নিয়েছিলেন ২০১০ সালে। এখনো চোখের সামনে ভাসে মায়ের সেই হাসিমাখা মুখ। আমার মা ডাক্তারের ভুল চিকিৎসার কারণে দুটো চোখই অকালে হারিয়েছিলেন। কিন্তু মায়ের ষষ্ট ইন্দ্রিয় খুবই প্রখর ছিল। মায়ের অন্তর্দৃষ্টি ছিল খুবই স্বচ্ছ। আমার মায়ের দৃষ্টি না থাকলেও যখন মায়ের কাছে কেউ আসতো, মা তাদের কথা বা সুর শুনেই বলে দিতে পারতেন সেই মানুষটি কে। এমন কি দীর্ঘ বছর পরে হলেও মা তাদের নাম বলতে পারতেন। অনেক সময় দূর থেকে মায়ের কোন আত্মীয় বা পরিচিতজন মাকে দেখতে এলেও সেই মানুষটির কন্ঠস্বর শুনেই মা বলে দিতে পারতেন তিনি কে, তার বাবার নাম, মায়ের নাম, গ্রামের নাম, ইত্যাদি। বিয়ের আগে মা রাঙ্গামাটিয়া মিশন স্তুলে শিক্ষকতা করেছিলেন এবং সারা জীবন মা আমাদের সেই শিক্ষায় পরিচালনা করেছেন।


মা সারা জীবন মারীয়ার সেনা সংঘের সদস্য ছিলেন। দীর্ঘ ১৪ বছর মায়ের চোখের দৃষ্টি না থাকলেও সেনা সংঘের সব প্রার্থনা মা মুখস্থ বলতে পারতেন। আমি অনেক সময় অবাক বিস্ময়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম কিভাবে মা এতগুলো প্রার্থনা মনে রাখতে পারতেন আর পর পর সব প্রার্থনাগুলো আওড়াতেন।আমি প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাড়ী পৌঁছাতাম ঢাকা থেকে। মা দুপুরের পরে আর কিছুই খেতেন না। মায়ের ডায়াবেটিকস থাকায় মাকে ঘন ঘন খেতে হত কিন্তু বৃহস্পতিবার মা বিকালে আর কিছু খেতেন না শুধু আমার অপেক্ষায় থাকতেন। আমি বাড়ীতে পৌঁছালে যা কিছু খাবার মায়ের জন্য প্রস্তুত করতো আশা, সেগুলো আমরা দুই মা-মেয়ে খেতাম।মনে পরে, আমি ম্যানিলা থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারী দেশে ফিরে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা চলে যাই বাড়ীতে। আশাকে বলি মাকে জানাতে যে আমি দেশে ফিরেছি। আমি ঘরে প্রবেশ করার সাথে সাথে মা আমাকে বললেন, “মা, তুমি কোথায় ছিলে এক মাস? এই এক মাস তুমি আমার সাথে কথা বলনি কেন?” মাকে বললাম, বিশেষ কাজে দেশের বাইরে যেতে হয়েছিল। মা চুপ করে থাকলেন।


আমার সৌভাগ্য হয়েছিল মায়ের কাছে শেষ একটি সপ্তাহ কাটানোর। এই এক সপ্তাহ মায়ের পাশে ঘুমিয়েছি, মায়ের সাথে খেয়েছি, মাকে যত্নআত্মি যা করার সেগুলো করার সৌভাগ্য হয়েছিল। ৮ই মার্চ সোমবার দুপুরে মাকে স্নান করানোর পর মা আর হাটতে পারেননি। আশা ও আমি মাকে ধরে বিছানায় দেবার পর মা আর নড়াচড়া করতে পারেননি। মুখে দুধ বা পানীয় কিছু দিলে তা শুধু গলধ:করণ করতে পারতেন। পুরো দুটো দিন আমরা (ফ্রান্সিস, আশা ও তার তিন ছেলেমেয়ে ও আমি) মাকে নিয়ে সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন ছিলাম। মায়ের পাশটি থেকে এক মিনিটের জন্যও কোথাও যাইনি, চোখের পাতাও বন্ধ হয়নি। রাত আড়াইটায় ফ্রান্সিস আমাকে বললো, “দিদি, আপনি একটু ঘুমান, খুব ক্লান্ত”। আমি বললাম, মায়ের কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করলে যেন আমাকে ডাকে। আর আমি মুহূর্তেই ঘুমিয়ে পড়লাম। অল্প কিছুক্ষণ পরেই ফ্রান্সিস আমাকে ডাকছে, “দিদি, মা যেন কেমন করছে।” আমি উঠে পড়লাম আর প্রার্থনা করতে শুরু করলাম। মায়ের মুখে সবাই জল ও দুধ দিলাম। মাকে প্রাণভরে ডাকলাম, ডুকরে ডুকরে কাঁদলাম। আজও সেই ৯ই মার্চ, বাংলাদেশে এখন দিবাগত রাত ৩টা ২০ মিনিট, বৃহষ্পতিবার, যখন মা আমাদের এই মায়াবী সংসারের মায়া ছিন্ন করে স্বর্গীয় মা মারীয়ার কোলে স্থান করে নিলেন। আর আমরা চিরদিনের জন্য মাকে হারালাম। এই মূহুর্তে জোরে জোরে মাকে ডাকলাম, একলা ঘরে বসে মায়ের ছবির সামনে বসে মাকে প্রাণভরে ডাকলাম। অন্তরচক্ষু দিয়ে মাকে দেখে জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম। মা যেন আমাকে বলছেন, ”মা, তুমি কাঁদছ কেন মা? আমি তো সুখেই আছি”। মায়ের কাছে বসে সারা সকাল ও দুপুর শুধু কেঁদেছি, নিজেকে হালকা করেছি, কারণ পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই যাকে আমার মনের কথাগুলো বলতে পারি, আমার অনুভূতিগুলো জানাতে পারি। মাগো আমাকে আর একবার জড়িয়ে ধরো মা, একবার চুমো খাও না মা! আমি যে তোমার একটি চুমুর কাঙ্গাল মাগো! আমাকে আর কেউ তোমার মত ভালবাসে না, কাছে ডাকে না, মধুর কন্ঠে বলেনা, মা, ঈশ্বর তোমাকে একটি বড় ক্র‍ুশ দিয়েছে, সেটা তোমাকে বইতেই হবে। কিন্তু ভয় পেয়োনা, যীশু ও মা মারীয়া তোমার সঙ্গেই আছেন, তারাই তোমাকে এই ক্র‍ুশ বইতে শক্তি দেবেন।


ঠিকই মা, তুমি চলে যাবার পর যীশু ও মা মারীয়া আমাকে তোমার মতই আগলে রেখেছে, শত বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন মাগো। পৃথিবীতে মা হারানোর বেদনা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। এটা শুধুই অনুভূতির ব্যাপার। আমি মাকে হারিয়ে আমার জীবনের সবকিছুই হারিয়েছি। যার জীবনে মা ছাড়া আর কেউ নেই, শুধু সে-ই বুঝতে পারে মাকে হারানোর বেদনা। মায়ের মত আপন কেহ নাইরে, মায়ের মত আ‌পন কেহ নাই…।
মা, আমরা সবাই আছি তোমার আশীর্বাদে। আমাদের জন্য সর্বদা আশীষ বর্ষণ করো যেন কোনক্রমেই তোমার শিক্ষা ও জীবনাদর্শ থেকে বিচ্যুত না হই। তুমি গিয়েছ যেখানে বাবা, তিন দাদা, ছোট ৪ ভাইবোন রয়েছে, তারা নিশ্চয়ই তোমোকে পেয়ে খুব আনন্দ করেছে তাইনা, মা? আমিও সামনে এগুচ্ছি এবং আশায় আছি কখন তোমাদের সাথে মিলিত হব। মাগো, বাবা ও অন্যান্যদের বলো যেন আমরা যারা এখনো এই সুন্দর বিশ্বে বেঁচে আছি আমরা যেন দেহ, আত্মায় ও মনে সুস্থ্য থাকতে পারি। ###
-------------
লেখক; আমেরিকা প্রবাসী একজন মানবাধিকার কর্মকর্তা।