হাসান আজিজুল হক
উপমহাদেশ খ্যাত কিংবদন্তী কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের জন্ম ১৯৩৯ সালে। তখনও দেশ ভাগ হয়নি। বৃটিশ আমল। ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলার কাটুয়া গ্রামের আর দশজনের মতোই বেড়ে উঠতে থাকেন। বেড়ে ওঠার সাথে সাথে ভারি হতে থাকে অভিজ্ঞতার ঝুলি। দেশ ভাগের সময় নয় বছরের শিশু তিনি। অন্যরা যখন কোন কিছুকে খুব স্বাভাবিক ভাবে দেখেছেন, গভীরে প্রবেশ করেননি তখন তিনি একটা উদ্দেশ্য নিয়ে বিশেষ ভাবে দেখতে শুরু করেন প্রতিটা বিষয়। দৃষ্টি ভঙ্গির এই তারতম্যই তাকে অন্য আর দশজন থেকে পৃথক করেছে।
কৈশরেই লেখালেখি শুরু করেন হাসান আজিজুল হক। ১৯৫৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। খুলনার দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক, রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে দর্শন শাস্ত্রে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রী এবং ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ছাত্রাবস্থায় দেশ ভাগের পর স্বদেশে আর ফেরা হয়ে ওঠেনি তাঁর। এদেশকেই স্বদেশ ভেবে আপন করে নিয়েছেন। কর্মজীবনে রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা গার্লস কলেজ ও ব্রজলাল কলেজে অধ্যাপনার পর ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। শেষ অবধি সেখান থেকেই তার অধ্যাপনা জীবন শেষ হয়।
ছাত্রাবস্থায় ভাঁজপত্র কলেজ ম্যাগাজিনে রাজশাহীর আমের মাহাত্ম্য লেখাটি প্রকাশিত হয়। সমসাময়িক সময়ে ছোট গল্প ‘মাটি ও পাহাড়’, ‘লাঠি’, ‘পাষাণ বেদী’র পাশাপশি কিছু কবিতাও প্রকাশ পায়। লেখক জীবন শুরু হওয়ার পর ১৯৬০ সালে যখন তার শকুন গল্প প্রকাশিত হয় তখন তিনি ব্যাপক ভাবে আলোচনায় আসেন।স্বনামধন্য পত্র পত্রিকায় একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে তার লেখা।অবলোকন করেছেন ভাষার জন্য বাঙালির ত্যাগ। বাংলাদেশ তখন পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনে। ভাষার লড়াই, স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা,অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানীদের দাবী আদায়ের সংগ্রাম প্রত্যক্ষ ভাবে উপলব্ধি করেছেন তিনি। শোষিত বঞ্চিত মানুষের সাথে এক কাতারে বাস করতে গিয়ে তাদের দুঃখ দুর্দশা নিবিঢ়ভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছেন যা হয়ে উঠেছে তার লেখার উপজীব্য বিষয়। বিশেষত সমাজের নিচু স্তরের মানুষ, যাদের বেঁচে থাকতে হয়েছে সংগ্রাম করে, ক্ষুধা তৃষ্ণা মেটাতে যারা নাস্তানাবুদ হচ্ছিলেন তাদের চরিত্রকে তিনি ফুটিয়ে তোলেন নিজের মতো করে। তাইতো তার অভিজ্ঞতা ভিত্তিক গল্প,প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক, শিশু সাহিত্য হয়ে ওঠে মজবুত ও মর্মস্পর্শী।তার লেখার ধার আকৃষ্ঠ করে পাঠককে।
কথার জাদুকর হাসান আজিজুল হক তার গদ্যের বর্ণনার মহিমায় যখন ইনিয়ে বিনিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বক্তব্য পরিষ্কার করে দেন তখন তা সহজেই বোধগম্য হয়েওঠে পাঠকের কাছে। ফলে যেমন সক্ষম হন সময়ের চাহিদা মেটাতে তেমনি বাড়তে থাকে তার জনপ্রিয়তাও। কথায় যেমন অন্যদের মুগ্ধ করতেন তেমনি তার লেখা পড়েও মানুষ মুগ্ধ হতো। শেষটা কিভাবে করেছেন পাঠকের মধ্যে এ কৌতুহল বোধ সব সময় থাকতো। তার গদ্যের বিচিত্রতা অনুধাবন করতে, ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ পেতে তার পাঠক উন্মুখ থাকতেন। এখানেই তার স্বার্থকতা।দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক বিধায় ভাবতেন জগত জীবন ইশ্বর আত্মা দেশ কালসহ নানা বিষয় নিয়ে। সক্রেটিস, এরিষ্টল, প্লেটোসহ বিশ্বের খ্যাতনামা দার্শনিক, দেশ বিদেশের দর্শন, চিন্তা পড়তে-পড়তে, পড়াতে-পড়াতে তার মধ্যেও গড়ে ওঠে নিজস্ব চিন্তার জগত; ভাবনার জগত। যে জগতে কেবল তারই আধিপত্য। আর সেই জগতের মত ও পথের সাথে অন্যদের পরিচয় করিয়ে দিতে কলমের বান দিয়ে প্লাবনের মতো প্রবাহিত করেন সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন, নামহীন গোত্রহীন, পাতালে হাসপাতালে, আমরা অপেক্ষা করছি, রাঢ় বঙ্গের গল্প, রোদে যাবো, মা মেয়ের সংসার গল্পগ্রন্থসহ আরো অনেক গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক ও শিশুতোষ লেখা। ফিরে যাই ফিরে আসি, উঁকি দিয়ে দিগন্ত, টান, লন্ডনের ডায়েরীর মতো আত্মজীবনী যেমন লিখেছেন তেমনি সম্পাদনাও করেছেন বেশ কিছু গ্রন্থ। তার রচনা সমগ্র মানুষকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। তিনি হয়ে ওঠেন কয়েক যুগের সমষ্টি।
কোন ঘটনার সহজ, সরল, প্রাঞ্জল বর্ণনার শিল্পী ছিলেন প্রগতিশীল লেখক হাসান আজিজুল হক। সিদ্ধ হস্ত লেখার পাশাপাশি ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী। হাস্যোজ্জ্বল অনন্য ও বাস্তবতার নিরিখে মানুষের মননের অব্যক্ত বেদনা উপলব্ধির চূড়ান্ত রূপায়নের কারিগর মানবতাবাদী এ লেখক একাধারে ছিলেন পথ প্রদর্শক ও স্বপ্ন দ্রষ্টা। পোশাক পরিচ্ছদ ও জীবন যাপনে খুব সাধারণ হলেও তার চিন্তা-চেতনা,মননশীলতার গভীরতা তাকে নিয়ে যায় এক অনন্য শিখরে। তাই তো জীবদ্দশায় বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কারসহ আরো অনেক পুরষ্কার ও সম্মাননা তার গলায় মালা হয়ে শোভা বর্ধন করেছে। উপাধি পান “সাহিত্যরত্ন”।
সোনার তরীতে ঠাঁই হয়নি তাঁর। ফলানো সোনার ফসল রয়ে গেছে সোনার তরীতে।পাঠক তার নতুন লেখার স্বাদ আর কোন দিনই আস্বাদন করতে পারবে না জানি তথাপি এক জীবনে তিনি যা লিখে গেছেন তা চর্বিত চর্বণ করতে পারটাই বা কম কিসে। তার লেখার মজবুত ভিত প্রভাবিত করবে পরবর্তী প্রজন্মকেও। তিনি হয়তো আরো লিখতে চেয়েছিলেন। কি নিয়ে লিখতেন নতুন লেখা, পাঠকের এ ভাবনা ও তাঁর সৃষ্টিই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্ত কাল।
লেখক -ইকবাল কবীর রনজু' সাংবাদিক, সাহিত্যিক।
সহকারি অধ্যাপক, মির্জাপুর ডিগ্রী কলেজ, চাটমোহর, পাবনা, বাংলাদেশ।