ছবি:সংগৃহীত
আমার জীবনে প্রথম শিক্ষক শিক্ষিকার নাম জেরু'র মা। এই জেরু'র মা- ই পরিবারের বাইরে, প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে আমার প্রথম অক্ষর জ্ঞান দাতা। জেরু'র মা'র পুরো নাম আগ্নেশ ডি কস্তা। পরবর্তীতে আমরা সে-ই শিক্ষিকাকে আগ্নেশদি বলেই সম্বোধন করেছি।
আমাদের এলাকায় পরিবারে বড় সন্তানের নাম ধরেই সাধারণত সন্তানের বাবা - মা'কে ডাকা হয় বা বড় ছেলে - মেয়ের নাম জড়িয়ে সম্ভোধন করার রেওয়াজ দীর্ঘকাল ধরে। এটা সম্ভবত আমাদের পুরো দেশেরই রেওয়াজ। জেরু ছিলেন পরিবারের বড় সন্তান। যে কারণে শিক্ষিকার পরিচয় ছিল তার প্রথম সন্তানের নাম অনুসারে। আমার ছোট বেলায় জানা জেরু-ই হচ্ছেন আমার আজকের আলোচনার এই জেরম ডি কস্তা।
মনে পড়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে আমরা ঘরবাড়ি ছেড়ে রাজাকার আর পাকিস্তানি সেনাদের ভয়ে শরণার্থী হয়ে এলাকা থেকে অনেক দূরে এক অজ পাড়াগাঁ'য় আশ্রয় নিয়েছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র কিছুদিন আগে সংবাদ পেলাম এভাবে যে, জেরু'র বাবাকে পাকসেনারা মেরে ফেলেছে। ঘটনার পরবর্তীতে আমাদের আশ্রয়স্থলে এই ঘটনা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। যে কারণে আমার মনে বিষয়টি এখনো স্পষ্ট।
ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয় এভাবে, বাড়িতে যখন সৈন্যরা ঢুকে পড়ে জেরু'র বাবা তখন পালানোর জন্য বাংকারে ঢুকছিলেন, এমন সময় পাকসেনারা তাঁকে উদ্দেশ্য করে গুলি করলে তাঁর মাথার খুলি উড়ে যায়। ঘটনার বিবরণ শুনে মনে হয়েছিল, কতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটিয়েছে পাকিস্তানি সৈন্যরা।
১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা যখন পোড়া ভিটা বাড়িতে ফিরে আসি তখন পরিবারের সবাই বাড়ি গোছানো নিয়ে ব্যস্ত। ঘর পোড়া ছাইয়ের স্তুপ সরিয়ে যখন রাতে থাকার মতো কিছুটা ব্যবস্থা করা হয়, মাকে তখন বলতে শুনি, জেরু'র মা'র বাড়ি যাবে দেখতে। মা'র কথা শুনে আমিও তখন রওনা দিলাম মায়ের সাথে। আমাদের বাড়ির দুই বাড়ি পর তাদের বাড়ি হলেও এর আগে কখনো আমার যাওয়া হয়নি।
দেশ স্বাধীন হবার পরই আমার প্রথম যাওয়া হয় জেরম ডি কস্তাদের বাড়ি। এরপর নানা কারণে যদিও তাদের বাড়িতে আমার অনেক যেতে হয়েছে, তারপরেও প্রথম যাওয়ার বিষয়টি আমার মনে আছে বেশ । তবে গ্রামের বাড়িতে তাকে আমি একবারই দেখেছি, তা ছিল তার বিয়ের দিন। এছাড়া আর কখনো নিজ বাড়িতে বা এলাকায় তাকে কখনো দেখেছি বলে আমার মনে পড়ে না।
জেরম ডি কস্তাকে আমি যতবারই দেখেছি বা তার সাথে দেখা হয়েছে, ততবারই পুরাতন ঢাকার লক্ষ্মীবাজার এলাকায় তার বাসায় কিংবা সাপ্তাহিক প্রতিবেশী-র সামনে দেখেছি বা দেখা হয়েছে। দেখা হলে প্রথমই জানতে চাইতেন আমার বাবা - মা কেমন আছেন? প্রতিবারই ছিল এমন প্রশ্ন যার ব্যতিক্রম দেখিনি কখনো। তার কথায় বরাবরই ছিল বেশ মিষ্টতা। তাকে কখনো উঁচু স্বরে কথা বলতে শুনিনি। এমনভাবে কথা বলতেন যে, নিজেরও কখনো মেপে কথা বলা ছাড়া উপায় ছিল না। খুব কম কথা বলতেন যে কারণে কথা বলতে ভয়ও পেতাম বেশ। তবে কোনো কারণে যখন হাসতেন তখন একদম মন খুলে হাসি দিয়ে আশপাশে সকলকে জানান দিতেন।
আমি যতবারই তার বাসায় গিয়েছি ততবারই দেখেছি তাকে বই নিয়ে বসে পড়তে। ঘরে ছিল তার অনেক বই। যার বেশিরভাগ ছিল দুষ্প্রাপ্য এবং মূল্যবান। প্রচুর বই পড়তেন তিনি। যে কারণে জ্ঞান ভান্ডারও বলতে পারি তাকে।
আমি দেশে ছাত্রাবস্থায় দৈনিক সংবাদ পত্রিকার অফিসে প্রায়ই যাওয়া আসা করতাম। একবার বড়দিন উপলক্ষে দৈনিক সংবাদ পত্রিকার জন্য সিনিয়র সাংবাদিক শ্রী সন্তুষ গুপ্ত আমার একটি লেখা চেয়ে বললেন যতো তাড়াতাড়ি পারি, দিতে। এরপর আমি লেখাটি প্রস্তুত করতে জেরম ডি কস্তার শরণাপন্ন হয়েছিলাম। জেরম ডি কস্তা আমার লেখা পড়ে বেশ কিছু জায়গায় লাল কালি দিয়ে দাগিয়ে লেখার শেষ ভাগে বড় করে ইনভাইটেড কমা দিয়ে লিখে দিয়েছিলেন, " প্রচুর প্রচুর প্রচুর পড়তে হবে। পড়বে। পড়ার বিকল্প নেই তাই পড়ো।"
আমার যতটা মনে হয় লেখালেখি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে জেরম ডি কস্তার সাথে আমি যত আলোচনা বা পরামর্শ করেছি সেই তুলনায় অন্য কারো সাথে তার বিন্দু পরিমান করিনি। এমনকি নিজের লোকদের সাথে এই আলোচনা বা পরামর্শের পরিমান ছিল শূন্য।
তিনি একটি বড় কাজ করেছেন। যা " বাংলাদেশে খ্রিস্ট মন্ডলীর ইতিহাস " নামে একটি বই লিখেছেন। বইটি আমি কিনে পড়েছি। পড়ার পর লিখিত আলোচনাও করেছি। যা পড়ে তিনি আমাকে বলেছিলেন, বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ করার সময় আমার উল্লেখিত বিষয়টি তাঁর বইতে সংযোজন করবেন। তবে, বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ মনে হয় আর হয়নি। আমার সে-ই বিষয়টিও আর বইতে স্থান পায়নি।
প্রায় একই সময় তিনি প্রতিবেশী ছেড়ে ওয়ার্ল্ড ভিশন অব বাংলাদেশ -এ যোগ দিয়েছিলেন। একবার তারই কথায় আমি তার অফিসে গিয়েছিলাম কোন এক সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রকাশিত স্মরণিকায় বিজ্ঞাপনের জন্য। সেদিন তার সাথে আমার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খোলামেলা অনেক কথা হয়। সেদিনের পর আমি আর কখনো তার সাথে দেখা করিনি।
আমি লক্ষ্মীবাজার তার বাসার খুব কাছাকাছি এক বাসায় থাকতাম, টিউশনিও করতাম একই এলাকায়। যে কারণে মাঝে মধ্যেই দেখা হয়ে যেতো আমাদের অনিচ্ছাকৃত ভাবে। তখন কথা না বলে এড়িয়ে যেতে পারিনি তাই নিজের বিষয় নিয়ে কথা বলতাম চলার পথে।
এরপর তো আমি চলে আসি জাপান, উনিও চলে গেলেন দেশের বাইরে। যে কারণে আমাদের দেখা বা কথা কখনো হয়নি আর। জেরম ডি কস্তা বিদেশে পড়ালেখা করেছেন। ফিরে এসে প্রতিবেশী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন সত্য কিন্তু মৃত্যুর পর অনেকেই আজ জানছেন তাকে প্রতিবেশী পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক হিসেবে। অথচ প্রতিবেশী তাকে তার জীবদ্দশায় যতটুকু মূল্যায়ন করার কথা ছিল ততটা করেনি যা আমি ফাদার জ্যোতি ডি কস্তা এবং তখনকার আর্চ বিশপের সাথেই আলোচনা করে বলেছি।
ফাদার জ্যোতিও ছিলেন প্রতিবেশীর একজন প্রাক্তন সম্পাদক। আসলে প্রতিবেশীর কথা বলবো কি, আমাদের সমাজ, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি কেউ -ই যোগ্য লোকের যোগ্য সম্মান বা মূল্যায়ন করিনা। যা করি বা দেখাই সব যেন মৃত্যুর পর করি বা দেখাই। অনেকটাই যেন মায়া কান্নার মতো।
জেরম ডি কস্তা আজ প্রয়াত। তার মৃত্যুতে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি। সে সাথে তার আত্মার শান্তি ও স্বর্গবাস কামনা করছি।