রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ভাদ্র ২৩ ১৪৩১

আমার দেখা একজন বই পাগল মানুষের সাথে আড্ডার কথা

পি আর প্ল্যাসিড

প্রকাশিত: ১৫:৪৩, ১০ নভেম্বর ২০২২

আমার দেখা একজন বই পাগল মানুষের সাথে আড্ডার কথা

হেনরী স্বপন

একজন বই পাগল মানুষ, নাম হেনরী স্বপন। সে আর কেউ নয় আমার বন্ধু,..কবি হেনরী স্বপন। জীবনানন্দ দাশের বরিশালে, ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারী তার জন্ম। বরিশালের গাছ-পালা, নদী, মাঠ, ঘাস, পাখি, পুকুর-ঘাট, পতঙ্গ তাকে ‘রূপসী বাংলা’ দেখিয়েছে। জন্মাবধি এখনো সে বরিশালের মাটি আকড়ে আছেন।

তিনি বরিশালের একটি এনজিও প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন বহুবছর। এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। অবসরে লেখালেখি করেই কেটে যায় তার অধিকাংশ সময়। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর লেখালেখি শুরু। এখন পুরোদস্তুর একজন লেখক বলা যায় তাকে। আবার এও বলা যায়, লেখালেখি করে বা লেখালেখির কারণে একবার কারাবাসও করেছেন, মৃত্যুর হুলিয়া বয়ে চলেছেন। শুধু তাই নয়, আমি যতটা জানি বাংলাদেশে তিনিই প্রথম ডিজিটাল আইনে গ্রেফতারকৃত লেখক, যিনি কারাগারে গেলে দেশব্যাপি ফেসবুক-টুইটারে ও রাজপথে তুমুল আন্দোলনের জন্য ছত্রিশ ঘন্টার মধ্যে সংশ্লিষ্টরা তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। বলা যায় বিতর্কিত আইসিটি মামলায় গ্রেপ্তার হওয়াদের মধ্যে এতো তাড়াতাড়ি তিনিই সর্বপ্রথম জামিনপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। এটাই তার লেখক জীবনের বড় প্রাপ্তি। লেখালেখির অনন্য উপহার।

বর্তমান সময়ে লেখালেখি করে সম্মাননা বা পুরষ্কার জোটে কেবল তাদেরই কপালে, যারা তেলবাজি করতে পারেন। যারা চাতুরতা এবং নমনম করতে পারেন তারাই সমাজের উঁচুস্তরে থাকেন। আর যারা অসাম্প্রদায়িক, ন্যায়-নিষ্ঠা, মানবতা ও সত্যের পক্ষে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান করেন, তাদের কপালেই জোটে যত হুমকি-ধামকি, নিন্দা, জেল-জুলুম। এসবই অবধারিত হয়ে ওঠে। ফলে, নিভৃতচারী কবি হেনরী স্বপনের কপালেও কেবল তা-ই জুটেছে।

তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, কলম ধরেছেন ন্যায়ের পক্ষে আর এজন্যই তার উপর নেমে এসেছিল ডিজিটাল আইনের প্রয়োগ বা খরগ। আমি এও জেনেছি যে, ২০১৫ সালে একটি জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা-তাদের আইডিতে হেনরী স্বপনের ছবি পোস্ট দিয়ে তাকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল। তখনও তিনি সরকারের তৎপরতায় ব্যাপক পুলিশি নজরদারিতে থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলেন। রাতের আঁধারে তার বাসভবনে এসে দুবৃত্তরা শাসিয়ে গেছেন একাধিকবার।

২০০১ সালে বিএনপি জামায়েত জোটের সন্ত্রাসিরা লেখালেখির জন্য হত্যার উদ্দ্যেশে তার বাড়িতে হানা দিয়েছিল। হেনরীকে না পেয়ে দুবৃত্তরা সেদিন তার বৃদ্ধ পিতা-মতাকেও মারধর করে। সর্বশেষ তিনি কতিপয় পুরোহিতের রোষাণলে পড়ে তাদের দেওয়া মামলায় ডিজিটাল আইনে গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন।

হেনরী স্বপনের জন্ম বরিশালে, বরিশালের মাটিতেই বেড়ে উঠেছেন। কবিতা লিখছেন, কবি জীবনানন্দ দাশের লেখালেখির বিষয় গবেষণা করছেন, জীবনানন্দ নামে বর্তমানে একটি সফল ছোটকাগজের সম্পাদনা করেন, এছাড়াও এখন সে বরিশালের অন্যতম পত্রিকা দৈনিক মতবাদের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন। বরাবরই আপোষহীন, স্পষ্টবাদী, মুক্তমনা লেখক হিসেবে, আজকে সে কবি লেখক হেনরী স্বপন হয়ে উঠতে পেরেছে।
 
হেনরী স্বপনের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল, আমি জাপান আসার আগে-- অর্থাৎ ১৯৮৯ সালে। এবং লেখালেখির সূত্র ধরেই আমাদের বন্ধুত্বর শুরু হয়েছিল। কিন্তু জাপান আসার পর আমার কর্মব্যস্ততা এবং নানাবিধ কারণে তার সাথে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রবাসে আমার এই কর্মব্যস্ততা বরাবরই আমাকে অনেকের কাছ থেকে  দূরে সরিয়ে নেয়। কঠিন ব্যস্ততার মধ্যে সামাজিকতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি সব সময়-সব ক্ষেত্রে। যে কারণে, অনেক বন্ধুদের মতো তার সাথেও আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আমি অবশ্য যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময়টা আজকের দিনের মতো মোবাইল, ইন্টারনের যোগাযোগ  সাধারণ মানুষের জন্য এতটা সহজ ছিল না।

আমরা একে অপর থেকে হারিয়ে গেলেও, তাকে আমি মনে রেখেছি-একেক সময় পরিচিত অনেকের কাছেই হেনরীর কথা জানতে চেয়েছি। এমনকি জাপানের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের জন্য প্রোগ্রাম তৈরী করতে বাংলাদেশে গিয়ে তার খোঁজ করেছি। তখন কোনোওভাবে খোঁজ পাইনি তার।

সম্প্রতি আমি এক বিশেষ কাজে ভারত গিয়েছিলাম। ভারত থেকে গত মে ২০২২-এ আমি বেনাপোল বর্ডার হয়ে, সড়কপথে বরিশাল গিয়েছিলাম। বরিশাল শহরে গিয়ে পরিচিত ও স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে শহরময় ঘুরে দেখার সময়, গরমে ক্লান্ত হয়ে এক পর্যায় চৌমাথা ব্রিজের ঢালে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে ডাবের পানি খাচ্ছিলাম। এমন সময় আমাদের পাশ দিয়ে  হেঁটে যাওয়া এই মানুষটিকে স্থানীয় সাংবাদিকদের একজন ডেকে আমার সাথে সংক্ষেপে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

সেখানে দাঁড়িয়ে দুজনে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বললাম৷ একে অপরের সাথে পরিচিত হলাম বটে, কিন্তু তখনো আমরা একে অপরকে চিনতে পারি নি। কিছু সময় কথা বলে যখন চলে যাবার জন্য মটরসাইকেলে উঠছিলাম, তখন আমি এখানে আশেপাশে কোনো ক্যাথলিক চার্চ থাকলে ভিজিট করতে চাই। এমনটা বললে হেনরী স্বপন আমাকে চার্চের ঠিকানা জানালেন, নিজের পরিচয়ও দিলেন একজন ক্যাথলিক বলে। আর তখন আমিও তাকে খুঁজে পাই। এভাবেই সেদিন আমরা আবার আমাদের পুরনো বন্ধুত্ব খুঁজে পাই। আর তখনই যাত্রা থামিয়ে, আবার আমরা কথা বলা শুরু করি, আমাদের বন্ধুত্বের শুরুর প্রসঙ্গ নিয়ে।  তখন সে, সাথের সাংবাদিকদের কাছেই থাকা চার্চের কথা বলে আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে বললেন। আমিও গিয়েছিলাম কাছেই থাকা চার্চে।

সেবার সময় স্বল্পতার কারণে আমি তার সাথে আর দেখা করে আসতে পারিনি। আমার মতো আমি চলে এলাম ঢাকায়। কিছুদিন পরেই আবার গেলাম বরিশাল। সেখানে স্থানীয় সাংবাদিক এম এন নোমানী আমাকে নিয়ে সুন্দর এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। আমি সেবারে বরিশাল যাবার আগে আয়োজক নোমানীকে অনুরোধ করে বলেছিলাম, হেনরী স্বপনকে যেন আমার এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত করা হয়। নোমানী কথা দিয়েছিলেন তাকে উপস্থিত করাবেন। সত্যিসত্যিই নোমানী হেনরী স্বপনকে উপস্থিত করেছিলেন। এমনকি তাকে মঞ্চে বসিয়ে সম্মানও দিয়েছেন। বিষয়টি আমার কাছে খুব ভালো লেগেছিল।

২৮ মে ২০২২ বরিশালে সাংবাদিক নোমানী আমাকে নিয়ে এক চমৎকার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। অনুষ্ঠান শেষে সবাই যে যার মতো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে, আমি আমার মতো শহর ঘুরতে বেড়িয়ে পরি। সাথে ছিলেন ঢাকা থাকে আসা আমার সফর সঙ্গীরাও। সে দিনের সেই রাতটি সত্যিই স্মরণীয় হয়ে থাকবে আমার কাছে। কারণ, সেদিন রাতভর রিকশা নিয়ে বরিশালে আমরা অনেক ঘুরেছি। আর সেদিনই সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম  শহরের গোল পুকুর পাড়, খ্রিস্টান পাড়ায়। সেখানেই হেনরী স্বপনের বাসা। সেদিন তার ছোট্ট ঘরে ঢুকেই আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। হেনরীর বইয়ের সমারোহ আর ঘরের ভিতরকার আয়োজন দেখে রীতিমতো আমার মাথা ঘুরে যায়। ছোট্ট একটা ঘর তার সর্বত্রই শুধু বই আর বই দিয়ে ঠাসা। যা সচরাচর কারো বাসায় এরকম আমি আগে কখনো দেখিনি। হেনরী স্বপনের এই আয়োজন, তার বইপ্রীতি দেখে, সেই থেকে তার প্রতি আমার অন্যরকম এক শ্রদ্ধা  এবং আরও গভীর ভালোবাসা জন্ম নেয়।

জাপানে আমার বাসার একটি ঘরেও এভাবে বইয়ের পসরা সাজিয়েছিলাম, যা এ-যাবৎ জাপানের অন্য আর কোনো বাঙ্গালির বাসায় চোখে পড়েনি। কিন্তু হেনরী স্বপনের ঘরে ঢুকে সেদিন কেবল আমি নয়, আমার সফর সঙ্গী রিপন এবং রীতা আক্তারও বিস্মিত হয়। আমি তাদের বলছিলাম, ‘যে মানুষটির ঘরে এতো বই থাকে সে কখনো খারাপ হতে পারে না।’

বলা যায়, সেদিনের পর থেকে মনে মনে তার সাথে আমি আমার নিজের বই পড়ার অভিজ্ঞতার তুলনা করছিলাম আর ভাবছিলাম আমি তার থেকে অনেকটাই পিছিয়ে আছি, যা তার এই বই সংগ্রহর ভান্ডার থেকেই আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে।

রীতা আক্তার বর্তমানে বিবেকবার্তার সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছে। সত্যি কথা, হেনরী স্বপনের বাসায় গিয়ে তার বইয়ের সংগ্রহ দেখে অবাক হয়েছি আমরা সকলেই। যে-কারণে তার বাসায় আমরা যতটা সময় ছিলাম পুরোটা সময়ই বই আর লেখালেখি এবং সাহিত্য নিয়ে আলাপ হয়েছে।

হেনরী স্বপনের পুরো পরিবার থাকে দেশের বাইরে, আমেরিকায়। সে একা বরিশালের বাড়িতে থাকছে। বরিশাল শহরের গোল পুকুর পাড়ে ছোট এক ঘরে বিশাল পৃথিবী বানিয়ে তার এই বসবাস। এই বইয়ের জন্যই দেশের বাইরে কোথাও তার যেতে মন টানে না বলে জানিয়েছে। দেশের মায়াও প্রকট হয়ে আছে তার অন্তরে। আমি তার, এই বইপ্রেমের কথা শুনে খুশি হলাম, আপ্লুতও হয়েছি বেশ। ইচ্ছে আছে দেশে গেলে আবার আমি, একদম দলবল নিয়ে ছুটে যাবো- আমার এই বন্ধু হেনরী স্বপনের বাড়ি। তার বিশাল সাহিত্য ভাণ্ডারের আস্তানায় সাহিত্যের আড্ডা জমাতে ফের যেতে চাই, সে-ই অপেক্ষায় প্রহর গুনছি-আমি।