নারায়ণ চন্দ্র মিস্ত্রি গ্রন্থাগার
ঝালকাঠি শহরের বাঁশপট্টি সড়কে ছোট্ট একটি টিনের ঘরে পরিবার নিয়ে বাস করেন নারায়ণ চন্দ্র। পেশায় কাঠমিস্ত্রি হলেও বই পড়ার প্রতি রয়েছে তার প্রচণ্ড আগ্রহ। বই পড়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষার কারণে নিজের বসতঘরেই গড়ে তুলছেন পাঠাগার। শুধু পাঠাগার গড়েই থেমে থাকেননি নারায়ণ চন্দ্র, যারা বই পড়তে আগ্রহী কিন্তু লাইব্রেরিতে আসতে পারেন না তাদের বাড়িতেও বই পৌঁছে দেন তিনি। কাজ শেষে বাড়ি ফিরে নিজে বাইসাইকেল চালিয়ে পাঠকের বাড়িতে বই পৌঁছে দেওয়াটা তার নেশা।
নারায়ণ চন্দ্রের বসতঘরে গড়ে তোলা এ পাঠাগারে বর্তমানে দেশি-বিদেশি লেখকের প্রায় ছয় হাজার বই রয়েছে। নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে পাঠাগারের নাম রাখেন ‘নারায়ণ চন্দ্র মিস্ত্রি গ্রন্থাগার’। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সব পাঠকের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় পাঠাগারটি। প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ জন পাঠক এখানে এসে বই পড়েন। ছুটির দিনে পাঠকের সংখ্যা বেড়ে যায়।প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে বিকেল পর্যন্ত নারায়ণ চন্দ্র বাইরে কাজ করেন। কাজ শেষে বাসায় ফিরে বাইসাইকেলে করে বিভিন্ন পাঠকের বাসায় বই পৌঁছে দেন।
ঘরের বারান্দাজুড়ে রয়েছে পাঠাগার। পাঠাগার কেন গড়ে তুললেন? জানতে চাইলে নারায়ণ চন্দ্র মিস্ত্রি বিবেক বার্তাকে বলেন, ‘অষ্টম শ্রেণি পাস করার পর অর্থের অভাবে পড়ালেখা বন্ধ করে আমাকে কাঠমিস্ত্রির কাজ শুরু করতে হয়। নিজে বেশিদূর পড়ালেখা করতে পারিনি। তাই অন্যরা যেন পড়ালেখা করে মানুষ হতে পারে সে স্বপ্নতেই লাইব্রেরি করেছি।’
ঝালকাঠিতে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কাঠমিস্ত্রির কাজ করছেন তিনি। বর্তমানে প্রতিদিন কাজ করে ৬০০ টাকা মজুরি পান। এই টাকা দিয়ে স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে সংসার চালানোর পর সামান্য যা অর্থ থাকে তা দিয়েই চলে পাঠাগারের ব্যয়ভার।এ ছাড়াও কাঠে খোদাই করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিভিন্ন গুণী ব্যক্তিদের দৃষ্টিনন্দন ছবি এঁকেছেন নারায়ণ চন্দ্র। যা দেখে অনেকে তার প্রশংসা করেছেন।পাঠাগারে বই পড়তে আসা পাঠক মোছাদ্দেক হাওলাদার বলেন, ‘নারায়ণ মিস্ত্রির লাইব্রেরিতে দুর্লভ অনেক বই আছে। যা পাঠ করলে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা যায়।’
নিয়মিত পড়তে আসা আরেক পাঠক আবদুল মান্নান তৌহিদ বলেন, ‘আমি প্রতিদিন এখানে বই পড়তে আসি। এখানে ধর্মীয়, ইতিহাস, সাহিত্য এমনকি বিভিন্ন দালিলিক প্রমাণের বই রয়েছে, যা পাঠ করে জ্ঞান অর্জন করতে পারছি।’স্থানীয় কলেজ পড়ুয়া ছাত্রী ইশরাত জাহান বলেন, ‘আমি কলেজে পড়ি। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি এখানে এসে বিভিন্ন ধরনের বই পড়ে অনেক কিছু জানতে পারছি।
পাঠাগারে গিয়ে দেখা হয় বেশ ক’জন শিশু পাঠকের সাথে। তাদের মধ্যে ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র হিমেল জানায়, আমি কার্টুনের বই পড়তে আসি। নারায়ণ কাকার কাছে মজার মজার কার্টুনের বই আছে। কলেজছাত্রী ছাত্রী কেয়া আক্তারের বাসা পাঠাগারটির পাশেই। তিনি বলেন, নারায়ণ কাকার পাঠাগারে পড়ার টেবিল চেয়ারের সংকট। তাই আমি বাসায় বই নিয়ে যাই, পড়া শেষ হলেই ফেরত দিয়ে আর একটি নিয়ে নেই। হুমায়ুন আহমেদ আর সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস আমার ভাল লাগে।
২০১৩ সালে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় থেকে নিবন্ধনও করিয়েছেন। সরকারি অনুদানে কিছু বইও পেয়েছেন। আর জায়গার সীমাবদ্ধতার কারণে বাড়ি বাড়ি গিয়েও পাঠকের কাছে বই পোঁছে দিচ্ছেন নারায়ণ চন্দ্র।পাঠাগার নিয়ে আলাপকালে নারায়ণ চন্দ্র বলেন, ‘২০০৩ সালে মাত্র ৩-৪টি বই দিয়ে লাইব্রেরির যাত্রা শুরু করেছিলাম। তখন আমার স্বল্প আয়ের একটি অংশ দিয়ে আমি এটি করেছিলাম। নিজের অর্থে পাঠকদের নতুন নতুন বই সংগ্রহ করে দিতে হয়। অর্থের অভাবে লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা বাড়াতে পারছি না। ছোট্ট ঘরে সব পাঠকদের বসার ব্যবস্থা করে দিতে পারছি না। আমার পক্ষে এটা করে দেওয়াও কষ্টসাধ্য। যদি বিত্তবানরা অর্থ বা বই কি সহযোগিতা করলে উপকার হতো।
ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক মো.জোহর আলী বলেন, নারায়ণ মিস্ত্রি অর্থনৈতিকভাবে তেমন স্বচ্ছল না। তবে তার উদ্যোগটি চমৎকার। আমি তার লাইব্রেরিটি পরিদর্শন করেছি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।