জয়প্রকাশ মণ্ডল
‘ধর্ম’ শব্দটির পশ্চাতে সংস্কৃতিগত পরিমণ্ডল কাজ করে। ভারতে ধর্মের সঙ্গে অনেক কিছু মিশে আছে।কিন্তু পাশ্চাত্যের মানুষ ধর্মকে আলাদা করে বুঝতে চায়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ধর্মের ধারণার মধ্যে এক ধরণের ফাঁক দেখা যায়। এই বোধোদয়ের মধ্যে রয়েছে হার্মিনিউটিক্স (মন্টজাভিনস,২০১৬)। যেমন ধর্ম একটা হতে পারে, যেটি সবক্ষেত্রে একইভাবে প্রয়োগ হবে। আবার ধর্ম আলাদা হতে পারে, যেটি ন্যায়,কর্তব্য, নীতি সবক্ষেত্রে আলাদা আলাদাভাবে প্রয়োগ হবে। ন্যায়ের ধর্ম কর্তব্য ধর্ম থেকে আলাদাহতে পারে। অর্থাৎ এখানে চূড়ান্ত কিছু নেই। ছান্দগ্য উপনিষদোপলব্ধি অনুযায়ী ধর্ম অধ্যয়ন করা ধর্ম।আবার ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান-যজ্ঞ মেনে চলাও ধর্ম। অন্যদিকে সেবা করাও ধর্ম। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে মহাভারতে যুধিষ্ঠীর-যক্ষের গল্পটি উল্লেখ করা যেতে পারে। যক্ষ যুধিষ্ঠীরকে ধর্মরাজ বলেসম্বোধন করছেন।
কিন্তু একবার যজ্ঞ করতে গিয়ে ব্রাহ্মণ যজ্ঞের কাঠ পাচ্ছিলেন না, তার ফলে যজ্ঞও বিলম্ব হয়ে পড়েছে, এমনকি যুধিষ্ঠির সমিধ সংগ্রহে (কাঠ জোগাড়ে) ব্যর্থ হলেন। অর্থাৎ যুধিষ্ঠির অধার্মিক হলেন। কারণ ব্রাহ্মণের সাহায্য করা রাজার কাজ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ধর্মের নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা দাঁড়াচ্ছে না। যুধিষ্ঠির একদিকে ধর্মচ্যুত হচ্ছেন, আবার একদিকে ধর্মরাজ হচ্ছেন। আসলে ধর্ম একটা নয়, ধর্মের অনেক রূপ আছে। এখন প্রশ্ন হল যে, ধর্মের অন্তরে বহুত্বের সন্ধান করা হবে , নাকি বহুত্বের অভ্যন্তরে ধর্মের একক সাধনা করা হবে ?
কোনটি ধর্ম, তাকে ধরা কঠিন। আমরা ধর্মকে ধরার চেষ্টা করেও তাকে ছুঁতে পারি না। রামায়ণে রাম সুগ্রীবের কথা শুনে বালীকে হত্যা করলেন। পরে মহাবলি বালীর কথা শুনে রামচন্দ্র অনুতাপ প্রকাশ করেন। এর পরে অবশ্য রাম বলেন যে, সুগ্রীব তাঁর বন্ধু এবং শক্তি প্রদর্শন করে সুগ্রীবের স্ত্রীকে বালি বিবাহ করেছেন। তাই রাম বালীকে হত্যা করে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। অপরপক্ষে বলা যায়, বানরদের মধ্যে ভাইয়ের স্ত্রীকে বিবাহ করা একটা প্রথা, তাই সেই প্রথা মাফিক বালী ভুল করেনি। রামের উচিত ছিল এই প্রথাকে রদ করে দেওয়া, কিন্তু রাম তা না করে অন্যায় করেছে। বালীকে রাম গোপনে হত্যাকরেছে। এটা অধর্ম।
তবে রাম এসবের উত্তরে বলেছিলেন, কূলধর্ম রক্ষার্থে সুগ্রীবকে সাহায্য করেছেন। সুগ্রীব রামের বন্ধু, তাই তিনি একাজ করেছেন। অথচ আমরা জানি, রাম কর্তৃক যেমন বালী পরাজিত হয়েছে। তেমনি আবার বালী কর্তৃক রাবণ পরাজিত হয়েছে। তাই কূলধর্ম রক্ষার জন্য রামের বালীকে গ্রহণ করা উচিত ছিল। কিন্তু রাম সেটি করেনি। যুধিষ্ঠীর ‘অশ্বথামা হত, ইতি গজঃ’- এই সম্পূর্ণ বাক্য প্রকাশ্যে বলেননি। অর্থাৎ তিনি পাপ করেছেন।তাই তাঁকেও কম সময়ের জন্য নরকে যেতে হয়।
রাম বালীকে পুনঃজন্ম দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বালী বলেছিলেন যে, তিনি রামের ভক্ত, সেই জন্য তার হাতে মৃত্যু ভাগ্যের ব্যাপার। এখানে ধর্ম কোনটি, বা অধর্ম কোনটি সেটি বলা কঠিন। সুতরাং ধর্মকে নির্দিষ্ট করা যাচ্ছে না। বিবেকের দংশনে পীড়িত হওয়াও ধর্ম। রাম কিন্তু এর বাইরেও নয়।
মনুসংহিতায় বলা আছে যে, সত্য আচরণ করা দরকার। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে সত্য আচরণ নাও করা যেতে পারে। প্রাণ রক্ষার জন্য যেমন অসত্যের আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে। সত্য আচরণ না করা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্ম অনুমোদন করে। এক জায়গায় যেটা সত্য, অন্য জায়গায় সেটি সত্য নাও হতে পারে। বিভিন্ন কনসেপ্ট অনুযায়ী সত্য-মিথ্যা অত্যন্ত ভঙ্গুর। কখন সত্য ধর্ম হবে বা কখন অসত্য ধর্ম হবে, সেটি কোনো কোনো সময় পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। আমাদের অপূর্ণতাকে পূর্ণ করে ধর্ম।
ধর্মের জগৎ পূর্ণের জগৎ, কিন্তু ধর্মের মধ্যে ঢুকে আমরা পূর্ণজগৎ পাচ্ছিনা। যেমন রাম ও যুধিষ্ঠির পূর্ণ মানুষ নয়। বককেও যুধিষ্ঠির ধর্ম ব’লে সম্বোধন করছেন। কোন একটা নির্দিষ্ট জিনিসকে ধর্ম বলা যায় না। ধর্ম অসম্পূর্ণ। ধর্ম প্রবাহিত হচ্ছে । রাম বালীকে হত্যা করলেও বালী কিন্তু রামের ভক্ত থেকে যাচ্ছেন। তাই রামের হাতে বালীর মুক্তি ছিল। রাম অন্যায় করেছেন, এটা বলা যায় না কারণ তিনি সমূহ পরিস্থিতির শিকার।
আবার ন্যায় করেছেন, তাও বলা যায় না।কারণ তিনি ভগবান বটে, কিন্তু অন্তর্যামী নন। তিনি মরমী দুঃখীর প্রতি, কিন্তু বালী-সুগ্রীবের সম্পর্কের ঐতিহ্য সম্পর্কে অবগত নন। তিনি রাজধর্মের দন্ড হাতে নিয়ে বিবেক ধর্ম থেকে আবার স্খলিত হচ্ছেন। যেমন, গর্ভবতী স্ত্রীকে কেবল কি বনবাসে পাঠালেন, নাকি স্ত্রীর গর্ভোদ্গম নিয়ে তিনি অবিশ্বাসের চোরাস্রোতে পিছলে যাচ্ছেন। ফলে এর পরবর্তী অংশে পিতাই জানেন না তাঁর সন্তান ‘কে’? তাই পিতা-পুত্রের যুদ্ধ রামায়ণ দেখল। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন তৈরি হয় যে, ধর্ম আসলে কি পারফেক্ট নয়, নাকি মানুষ নিজেই ইমপারফেক্শনকে ছেড়ে কোনো দিন পারফেক্ট হতে পারে না ?
আমরা যারা মানুষ, আমাদেরকে আরও সত্যের দিকে, আরও বেশি করে সৎ হওয়ার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে সেটিই হবে ধর্ম। আর ধর্মবোধ নির্ভর করে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে ব্যক্তির ভূমিকার উপর। কিন্তু পরিস্থিতির যাঁতাকলে যার কোনো পরীক্ষা-নিরিক্ষাই হয়নি, তাঁকে ধার্মিক বলে গণ্য করা আনুষ্ঠানিকতা ব্যতীত আর কিছুই নয়। অবশ্য যুগে যুগে ধর্ম নানানভাবে নির্মাণ হয়েছে এবং তার ব্যাখ্যাও কোনো কালে স্থির ছিল না। অর্থাৎ ব্যাখ্যা নির্দিষ্ট, নিটল থাকতে পারে না। যুগান্তরের হাতে পড়ে তার দর্শনেরও বদল ঘটে। সেখানে গ্রন্থ তো কেবল সূত্রধর মাত্র। তাই ধর্ম কখন কোন ঈশ্বরের সন্তানের হাতে এসে পড়বে, তার উপর নির্ভর করছে সমাজ, জীবন ও জগতের যাত্রা ও অস্তিত্ব। ফলত সবসময় আমরা কি ডিজার্ভ করছি তা হয়তো ধরতেই পারবো না, বরং যিনি রিজার্ভ করছেন তার পরিমণ্ডলে আমদের কক্ষপথ নির্দিষ্ট হতে থাকবে।
তথ্যসূত্র
1. মন্টজাভিনস, সি (২০১৬), ‘হার্মিনিউটিক্স’, দি স্ট্যানফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফিলজফি, ইউ এস এঃ সি এস এল
আই , ২২, জুন
2. অমলানন্দ, স্বামী (২০১৭), ‘মহাভারত কাহিনী’, কলকাতা: রামকৃষ্ণ মিশন ইন্সটিটিউট অব কালচার
3. (বাংলা ১৩৬২), “সপ্তকাণ্ড রামায়ণ”, কলকাতা: তারাচাঁদ দাস এণ্ড সন্স
4. নিত্যানন্দ স্বামী (বাংলা ১৩৮৭), “শ্রীম-দর্শন” (১৬ টি খন্ড), চন্ডীগড়: শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত পীঠ
5. সরদার, মনোরঞ্জন (২০১৭), "বুদ্ধদেব ও বৌদ্ধধর্ম", কলকাতাঃ পত্রলেখা
6. বর্মণ, ঝর্ণা (২০১৭), “রামায়ণের গৌণ গল্প”, কলকাতা: এভেনেল প্রেস
7. মহাস্থবির, রাজগুরু শ্রীধর্ম্মরত্ন (২০১১), “মহাপরিনিব্বান সুত্তং”, কলকাতা: মহাবোধি বুক এজেন্সি
(লেখকঃ অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, বঙ্গবাসী ইভনিং কলেজ, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)