রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ভাদ্র ২৩ ১৪৩১

রামকিঙ্কর বেইজ , সেই পুরোধা শিল্পীর ইতিহাস গর্ভে ফিরে দেখা

তন্ময় সিংহ রায়

প্রকাশিত: ১৩:২৯, ১৪ এপ্রিল ২০২২

রামকিঙ্কর বেইজ , সেই পুরোধা শিল্পীর ইতিহাস গর্ভে ফিরে দেখা

তন্ময় সিংহ রায়

“স্রষ্টা যে চিরটাকাল’ই সৃষ্টিতে ঢালে নিজ প্রাণ ,
জীবদ্দশায় তথাপি কভু কি পায় যথার্থ সম্মান?
শত ব্যঙ্গ , লাঞ্ছনা , অপমান উপরন্তু নিরবে সয়ে ,
অমূল্য সেই সৃষ্টিকর্মে নিমজ্জিত মন , সমাজে চলে বয়ে!”
আর এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম তেমন কিছুই নয়।
 
বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বাঁকুড়া জেলায় , জল-কাদামাটি’র জগতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা কুমোরদের বৈচিত্র্যময় মূর্তি গড়ার সেইসব কাজ দেখে , ছেলেবেলা থেকেই তাঁর মন গর্ভে ধীরে ধীরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেড়ে উঠতে থাকে বাঁধভাঙা আনন্দ , আগ্রহ ও উৎসাহ!আর ঠিক এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই ক্রমবর্ধমান প্রেম ও নিষ্ঠা , সেই কুমোরদের অনুকরণ করে কাদামাটি দিয়ে হরেক রকমের মূর্তি গড়তে তাঁকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল তো বটেই , বরং ভবিষ্যতে শুধুমাত্র সৃষ্টি আনন্দের নেশায় বুঁদ হয়ে আমৃত্যু তিনি যে জীবনধারণ করবেন প্রায় মাতালরূপে , তাই বা কে আর জানতো? শুধু কি তাই? মধ্যকৈশোরের দোড়গোড়ায় এসে দাঁড়িয়ে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন বীর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবিও আঁকতেন তিনি।জীবনে চলার পথে , পুঁথিগত বিদ্যা যে তাঁর সঙ্গী বিশেষ হবেনা , তা তিনি বুঝে গেছিলেন সেই বাল্যকালেই।
 
জন্মসাল নিয়ে তর্ক-বিতর্ক থাকলেও , শান্তিনিকেতন সহ বিভিন্ন পণ্ডিতের মতানুযায়ী , ১৯০৬ সালের ২৫ মে , ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির বাঁকুড়া’র যুগীপাড়ায় এক প্রামানিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি , যেখানে প্রত্যন্ত সেই গ্রামের সিংভাগ মানুষ’ই ছিলেন দিনমজুর সম্প্রদায়ের।পিতা চণ্ডীচরণ পেশায় ছিলেন নাপিত ও মাতা সম্পূর্ণা ছিলেন দায়িত্বশীল গৃহবধূ।ক্ষৌরকর্ম করে টেনে-হিঁচড়ে সংসারের গুরুদায়িত্ব বহন করা পিতার কাছে আদৌ ছিল না ছেলেকে ছবি আঁকার মিনিমাম সরঞ্জাম কিনে দেবার মতো অর্থটুকুও!কিন্তু প্রতিমুহূর্তে করাল গ্রাস উঁচিয়ে থাকা দারিদ্রতা যে বারেবারেই অদম্য ইচ্ছাশক্তি’র কাছে বিপুলভাবে হয়েছে পরাজিত এ দৃষ্টান্তের মতই , তার প্রমাণ আছে ভুরিভুরি।‘ইচ্ছে যদি থাকে , উপায় তার বেরোবেই’-এর মতই ,
রঙ নেই , তুলি নেই , কিন্তু প্রকৃতির বুকে অন্যান্য উপাদান তো আছে?সবুজ রঙের জন্য জোগাড় করতেন শিম গাছের পাতার রস , হলুদের জন্যে বাটনা বাটা শিলের হলুদ , লালের জন্যে মেয়েদের পায়ের আলতা আর ছাগলের ঘাড় বা লেজের লোম কেটে কাঠির ডগায় সুতো জড়িয়ে বেঁধে নিয়ে বেমালুম চলত তাঁর রঙ-তুলির সেইসব খেলা।
 
ষোলো বছরের মেট্রিকুলেশনের পর , বাঁকুড়ার এক বিশিষ্ট সাংবাদিক ও প্রবাসী পত্রিকা’র সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের সহায়তায় , কুড়ি বছর বয়সে তিনি চারুকলার ছাত্র হিসেবে যোগদান করেন বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ে , এবং আচার্য নন্দলাল বসুকে তিনি পেয়েও যান একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে। শান্তিনিকেতনের কলাভবনে তাঁর কাজের নমুনা দেখে নন্দলাল বসু তো প্রথম দিনই বলে বসলেন , “তুমি তো সবই জানো , আবার এখানে কেন?” তারপর একটু ভেবে বলেন ,  “আচ্ছা বেশ , দু-তিন বছর থাকো এখানে।”আবার সেই মাষ্টারমশাই নন্দলাল বসু’ই ছিলেন কিন্তু মডেল-এর ঘোর বিরোধী , তিনি বলতেন ,“ওসব  মডেল-টডেল চলে পশ্চিমে।” , কিন্তু তবুও তিনি (বেইজ) ব্যবহার করেছেন মডেল।অবশেষে শান্তিনিকেতন থেকে ফাইন-আর্টস-এ ডিপ্লোমা অর্জন করে পরবর্তীতে বিশ্বভারতী’র ভাস্কর্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদে উন্নীত হন তিনি (রামকিঙ্কর)।
 
শান্তিনিকেতনে ভাস্কর্য গড়া’র কাজে মানুষটি একবার হয়ে পড়েছিলেন এতটাই ব্যস্ত , যে নিজের মায়ের বিশেষ অসুস্থতা’র খবর পেয়েও তিনি পারেননি দেখতে যেতে! নিচে উল্লিখিত এই মন্তব্যের দর্পণেই স্বচ্ছভাবে যেন প্রতিফলিত হয়ে ওঠে যে , নিজের সৃষ্টি’র প্রতি সততা , নিষ্ঠা , ধৈর্য , প্রেম , ত্যাগ , মায়া , সহনশীলতা সর্বোপরি আবেগ প্রভৃতি , কিংবদন্তি এই ভাস্কর্য শিল্পীর ছিল ঠিক কোন স্তরে?
 
“আমি যখন শান্তিনিকেতনে খুব ব্যস্ত ছিলাম কিছু ভাস্কর্য গড়া’র কাজ নিয়ে , তখন আমার মা মারা যান! মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়েও আমি দেখতে যেতে পারিনি আমার মাকে , বড্ড খারাপ লেগেছিল সেদিন! কিন্তু মায়ের সে মৃত্যু , স্পর্শ করতে পারেনি
আমার শিল্পের ছায়াকে! এরপর একে একে সবাই মারা গেছেন ,আমার বাবা , দাদা , বোন সবাই , সবাই!…মৃত্যু সম্পর্কে আমি সব সময়’ই উদাসীন!একজন শিল্পী সৃষ্টির নেশায় মাতাল হয়ে থাকেন যতক্ষণ পর্যন্ত , ততক্ষণ পর্যন্ত মৃত্যু কোনোভাবেই স্পর্শ করতে পারে না তাঁকে!” – রামকিঙ্কর বেইজ
 
আকণ্ঠ সুরাপানে এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পী’র ছিল অফুরান আনন্দ!আর সেই আনন্দেই তিনি বিভোর হয়ে থাকতেন তাঁর অবিস্মরণীয় সব শিল্পকর্মে। কখনও ক্যানভাসে রঙ-তুলির আঁচড়ে মগ্ন হয়ে , তো কখনও আবার সিমেন্ট-বালি ও পাথরকুচির সংমিশ্রণে জীবনভর অজস্র শিল্পসম্ভারে তিনি গড়ে তুলেছেন তাঁর অনন্য সব সৃষ্টিসম্ভার। একজন প্রথিতযশা শিল্পী হয়েও পরবর্তীকালে কিন্তু তিনি কখনই ভোলেননি তাঁর কিশোর বয়েসের সেই প্রথম শিক্ষক অনন্ত সূত্রধর-এর কথা।
এমনকি দু’চার আনা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নিষিদ্ধপল্লীর রমণীদের মূর্তি গড়ার মাধ্যমে তাঁর ভাস্কর্যের সহজপাঠ গ্রহণকেও আ-মৃত্যু ভুলে যাননি তিনি।শান্তিনিকেতন সহ বেশ কিছু জায়গায় তাঁর এই ‘প্রামাণিক’ পদবী নিয়ে ঠাট্টা-মশকরাও চলতো বেশ।
পরবর্তী সময়ে তিনি সংস্কৃত-এর ‘বৈদ্য’ নামক শব্দ (সংস্কৃত: वैद्य) , ঋগ্বেদে যার অর্থ বেদজ্জাতঃ বা বেদ হতে জাত এবং প্রাকৃত ‘বেজ্জ’-এর পরিবর্তিত রূপ ‘বেইজ’ পদবী জুড়ে দেন নিজের নামের সাথে , ফলে প্রামাণিক পদবী সরে গিয়ে তাঁর পরিবার ব্যবহার করতে শুরু করে ‘বেইজ’ পদবী , আর ক্রমে তিনি পরিচিতি অর্জন করেন রামকিঙ্কর বেইজ নামেই।
 
” শোন , কাছে আয়।
তোর ভাস্কর্য দিয়ে ভরিয়ে দে আমার সবখানে।
একটা শেষ করবি , আর সামনে এগিয়ে যাবি – সামনে। “
স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাঁকে ভক্তি-শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস ভরে বলেছিলেন এ কথা।
আর কবির এই নির্দেশ মেনেই তিনি হয়তো আর তাকাননি পিছন ফিরে ঠিক’ই , কিন্তু এগিয়ে যেতে গিয়ে প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপেই তাঁর শিল্পীসত্তার অস্তিত্বকে পড়তে হয়েছিল ছিল দুঃখ-দহনে!
তাইতো বিশ্বভারতীর বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ সুসজ্জিত হয়ে উঠেছে তাঁর শিল্পকর্মের জাদুতে!
এমনকি রবি ঠাকুর ভালোবেসে তাঁকে সম্বোধন করতেন শান্তিনিকেতন-এর ”এক অন্যরকম বাসিন্দা” বলে।
প্রথাগত শিক্ষাকে তোয়াক্কা না করে , নিজেই এক শিক্ষারূপে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠা ও সমগ্র দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সেই শিল্পব্যক্তিত্বটি স্বয়ং রামকিঙ্কর বেইজ ব্যতীত
আর কেউ যে নন , তা আশা রাখি এতক্ষণে  বুঝে গেছি আমরা প্রায় সকলেই।
 
ভারতীয় আধুনিক শিল্পের জনক ও পথিকৃৎ এই শিল্পী’র কয়েকটি ভাস্কর্য শান্তিনিকেতন , কলাভবন , প্রয়াত রানী চন্দ সংগ্রহ , চারুকলা একাডেমী প্রভৃতি সহ বিভিন্ন স্থানে রয়েছে সু-সংরক্ষিত , এবং প্রদর্শিত রয়েছে ন্যাশনাল গ্যালারি অব মর্ডান আর্ট , নয়াদিল্লি’র দিল্লি আর্ট গ্যালারি , রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া , দুবাইয়ের কিতো ডি বোয়ার , কর্ণাটকের চিত্রকলার পরশহাট ও নয়াদিল্লি’র ললিত কালা একাডেমি ইত্যাদিতে।বলাবাহুল্য , মৃত্যুশয্যায়ও হাসপাতালে থাকার সময় তাঁর শেষ ভাস্কর্য দুর্গামূর্তিটি গড়ার মাধ্যমে এই মানুষটি প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন তাঁর শিল্পকে এভাবে , যেন মনে হয়েছিল যে এ জীবনে সময়টা বড়ই কম পেলেন তিনি , আরো বেশ কয়েকটা বছর বাঁচতে পারলে হত বড় ভালো! তাঁর সৃষ্টিকর্মে প্রকৃতি ও প্রান্তিক মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় ব্যাপকভাবে। বহু না পাওয়ার মাঝেও তাঁর উপরে বর্ষিত হয়েছিল অজস্র মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা! এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর মৃত্যুর ঠিক দশ বছর আগে ভারত সরকার তাঁকে ভূষিত করেন “পদ্মভূষণ” সম্মানে।
১৯৭৬ সালে তিনি নির্বাচিত হন একাডেমির ফেলো হিসেবে। ব্যক্তিগত জীবনে অগোছালো ও অর্ধউলঙ্গ এই শিল্পীকে বিশ্বভারতী “দেশিকোত্তম” দেয় ১৯৭৭ সালে। এর পর ১৯৭৯ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্জন করেন সাম্মানিক “ডি-লিট।”
 
রামকিঙ্কর বেইজকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানানোর একান্ত তাগিদে অসুস্থ শরীরেও পায়ে হেঁটে বোলপুরে এসেছিলেন অকল্পনীয় প্রতিভাবান ও কিংবদন্তি ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক। অবশেষে ১৯৭৫ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করলেও , দুর্ভাগ্যবশতঃ ১৯৭৬-এ বিশেষত বাংলার লক্ষ-কোটি হৃদয়কে চিরবিদায় জানিয়ে দূরদেশে পাড়ি দেন ঋত্বিক ঘটক ,আর সেই কাজ থেকে যায় অসমাপ্তই! ফলে , ১৯৫১ সালের “বেদেনি”, ১৯৬৮-এর ” রঙের গোলাপ”-প্রভৃতি এর মতই ১৯৭৫ সালের “রামকিঙ্কর”-ও ঋত্বিক ঘটকের অসমাপ্ত ছবি ও তথ্যচিত্রের তালিকায় দখল করে নেয় জায়গা। বাংলা শিল্পের হৃদয় গভীরে ক্ষত ও আজীবনের এক অভাব সৃষ্টি করে , সর্বশেষ ১৯৮০ সালের ২ আগস্ট প্রোস্টেট গ্রন্থির রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি নিরবে বিদায় নেন এ গ্রহের মায়া ত্যাগ করে!