রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ভাদ্র ২৩ ১৪৩১

দরিয়ার দেশে দরিদ্রতা নয়

মো: হাসিবুর রহমান

প্রকাশিত: ২১:৫৪, ৩১ অক্টোবর ২০২২

আপডেট: ১০:১৭, ১ নভেম্বর ২০২২

দরিয়ার দেশে দরিদ্রতা নয়

ছবি:সংগৃহীত

দরিয়ার দেশে দরিদ্রতা নয় র্অথাৎ নদীমাতৃক দেশে দরিদ্রতা থাকতে পারে না; কেননা নদী হবে কৃষিকাজে সেচের আধার,নদী হবে মাছ চাষের উৎস, নদী যোগাযোগের পথ সহজলভ্য ও সুগোম করে । নদী পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। নদী পরিবেষ্টিত বাংলাদেশে নদীকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশে দরিদ্রতা থাকতে পারে না।বিশ্ব নদী দিবস-এর যাত্রা শুরু হ্য় ১৯৮০ সালে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির আনুষ্ঠানিকতায় রিভারস ডে পালন করা শুরু হয় ,যার ফলশ্রুতিতে এখন প্রতিবছর ২৫ সেপ্টেম্বরে পালিত হয় ‘বিশ্ব নদী দিবস’। নদী রক্ষায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়। বিশ্ব নদী দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে নদী রক্ষায় র্অথাৎ নদী দূষণ-দখল রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবেশ রক্ষায় নদী হচ্ছে পৃথিবীর আশীর্বাদ। প্রতি বছরই দিবসটি পালন হলেও দখল-দূষণে আমাদের দেশের নদ-নদীগুলোর অবস্থা অত্যন্ত করুণ। নদী দূষণের মাত্রা অত্যাধিক এবং দখল হয়ে গেছে বহু খাল-বিল-নদী। গত ৫০ বছরে দেশের নদ-নদীর সংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। ইতিহাস ও বই হতে জানা যায় আমাদের দেশে ৭০০ টি নদী ছিলো। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন র্বোডের গবেষণায় জানা যায়, এদেশে নদীর সংখ্যা ৪০৫ টি বিদ্যমান আছে। তবে তালিকায় থাকা নদীগুলোর মধ্যে দখল-দূষণে অনেক নদীর অবস্থা এখন সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে।

বন্যা, অতিবৃষ্টি, নদীভাঙন এদেশে প্রায় প্রতিবছরই হয়ে থাক। বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলের প্রায় ২০ শতাংশ ভূখন্ড বন্যা কবলিত হয়ে থাকে। অতিবৃষ্টি বা ব্যাপকভাবে বন্যা হলে সমগ্র দেশের ৫৫ শতাংশের অধিক ভূখন্ড বন্যার প্রকোপে পড়ে।গড়ে প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রধান প্রধান নদীসমূহে র্বষা মৌসুমে পানি প্রবাহ সৃষ্টি হয় অতি বৃষ্টি জনিত কারণে, দেশের আভ্যন্তরিন নদীসমূহে নিয়মিত খনন বা ড্রেজিং এর অভাব, পুকুর, খাল-বিল-ডোবাসমূহ ভরাট করার ফলে এবং পার্শ্ববর্তী দেশের নদীসমূহের পানি বৃদ্ধির প্রবাহের কারনে প্রতিবছর পলি জমে। পার্শ্ববর্তী দেশে বন্যা হলে সেখানকার বাঁধসমূহ নির্দ্বিধায় খুলে দেয়, সে ব্যপারে অবশ্যই দ্বিপাক্ষিক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশে সংঘটতি বন্যাকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়: মৌসুমী বন্যা, আকর্ষিক বন্যা, উচ্চ মাত্রার জোয়ারে সৃষ্ট বন্যা। ১৯৮৮ আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে অস্বাভাবিক বন্যায় সারাদেশে ভয়াবহতা দেখা দেয়। সে সময়ে সমগ্র দেশের ৬০% এরও অধিক এলাকা প্লাবিত হয় এবং জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। রাজধানী ঢাকা শহরও তখন ব্যাপকভাবে প্লাবতি হয়।

এবছরও পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ভয়াবহ বন্যায় বানভাসী মানুষের দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে হয়েছে।উজানের ঢলে বাড়ি-ঘর, ক্ষেতের ফসল তলিয়ে যাওয়া ও নদী ভাঙনের পর লাখ লাখ মানুষ ঘরের চালে, নৌকায় অথবা বেড়িবাঁধ, আশ্রয়কেন্দ্রে ও উঁচু রাস্তার ওপর আশ্রয় নিয়ে অমানবিক জীবন যাপন করে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের পাশাপাশি পোল্ট্রি খামার, ছাগল, ভেড়া, গৃহপালতি গবাদিপশুরাও বিপন্ন অবস্থায় পতিত হয়েছে। কুড়িগ্রাম গাইবান্ধা, জামালপুর,সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জ জেলার পদ্মা-যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, সুরমা-কুশিয়ারায় পানি বৃদ্ধির ফলে বন্যার পানি মধ্য-নিম্নাঞ্চলে ধাবিত হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। বন্যাকবলিত স্থানসমূহের পূর্বের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বন্যা বা অতি বৃষ্টি কবলিত স্থানসমূহকে ক্যাটাগরি অনুযায়ী জোনিং করে জনগনকে সচেতন করতে হবে, তাহলে বন্যার পানি অন্তত বাড়ি-ঘরে প্রবেশ করে ক্ষতি করবে না। খাল-বিল, পুকুর এবং নদী খনন ও পুন:খনন করে অধিক পরিমানে পানি ধরে রাখতে পারলে নদীর পানি বৃদ্ধি ও অতিবৃষ্টির জন্য বন্যার প্রকোপে পড়তে হবে না। অপরদিকে খাল-বিল, নদীতে অধিক পরিমাণে পানি সংরক্ষণ করতে পারলে শীত মৌসুমে কৃষিকাজে পানির প্রয়োজন মেটানো সহজ হবে।এই জন্য প্রতি বছরই বন্যার সমস্যা সমাধানরে জন্য নদীতে ড্রেজিং ও খাল খননের উপর বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। কিন্তু সঠিক কৌশল ব্যবহার না করার ফলে বাঁধের দু’পাড়ে বৃষ্টির পানি জমার ফলশ্রুতিতে তীরবর্তী মানুষের কষ্ট ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি পায়।

এক রির্পোটে দেখা যায়, পদ্মা নদীতে ভাঙনের ফলে রাজবাড়ীর সদর উপজেলার বড়চর এলাকায় পদ্মার তীররক্ষা ব্লকের ৮৭ভাগ মাটি ধ্বসে গেছে। ঐ এলাকার অন্তত তিন কিলোমিটার এলাকায় ভাঙন অব্যাহত আছে। সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের বড়চর নবীনগর, কাকিলদাইর, মহাদেবপুর গ্রামে ভাঙন শুরু হয়েছে। বড়চর নবীনগর গ্রামে তীররক্ষা প্রকল্পের ব্লক ধ্বসে গেছে। ব্লকের পশ্চিমদিকে বালুর ব্যাগ ফেলা হয়েছে (সূত্র: দি ডইেলি স্টার)। দেখা যায়, সিমেন্টের ব্লক দিয়ে তৈরী বাঁধ সচারচর পানির স্রোতের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে ব্লকগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে অতি সহজে নদীতে গড়িয়ে পড়ে। এভাবে ধীরে ধীরে নদীর তলদেশে সিমেন্টের ব্লক জমা পড়ে নদীতে ভরাট শুরু হবে, যার ফলে নদীতে পলিমাটি জমা বৃদ্ধি পাবে এবং নদীর নাব্যতা কমে আসবে। ফলে নদীতে বন্যার পানি সামান্য বৃদ্ধি পেলে এবং অতিবৃষ্টি হলে নদীর তীরবর্তী গ্রামে বন্যা দেখা দেবে ও জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এই কারণে সিমেন্টের ব্লক দিয়ে বাঁধ নির্মাণ অত্যন্ত দূরাবস্থা তৈরী করবে। কারণ সিমেন্টেরে ব্লক দিয়ে নদী ভরাট হলে ভবিষ্যতে নদীতে ড্রেজিং করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই, সিমেন্টের ব্লক দিয়ে বাঁধ নির্মাণ না করে ষষ্ঠভূজ আকৃতির ডিজাইনের ব্লক তৈরী করে বাঁধ নির্মাণ করলে ব্লকগুলো একে অপরের সাথে আঁকড়ে থাকবে ফলে ব্লকগুলো নদীতে গড়িয়ে পড়বে না। দেখা যায়, প্রতি বছরই সিমেন্টের ব্লক দিয়ে নদীর পাড় বাঁধাই করতে প্রচুর পরিমানে টাকা ব্যয় হয় কিন্তু তা কোন কাজে আসে না। ষষ্ঠভূজ আকৃতির ডিজাইনের ব্লক দিয়ে নদী ভাঙন রোধ করলে একবার খরচের মাধ্যমে র্দীঘমেয়াদী সুফল পাওয়া যাবে। স্থায়ীভাবে নদীভাঙন রোধে ফ্লাড-বেড পদ্ধতিতে বাঁধ নির্মাণ করা অতি প্রয়োজন। কারন নদী ভাঙন না হলে নদী তীরবর্তী গ্রামগুলি বন্যা প্লাবতি হবে না, জান-মালের ক্ষয়-ক্ষতি কমে আসবে এবং গবাদি পশু-পাখিও রক্ষা পাবে।

নদী ভাঙনে পৈত্রিক ভিটা-বাড়ি, ফসলরে জমি বিলিন হয়ে মানুষ হয়ে পড়ে র্সবহারা-শেকড় ছাড়া, এর চেয়ে দু:খজনক ও হৃদয়বিদারক আর কি হতে পারে? বানভাসী মানুষেরা সহায়-সম্বল হারিয়ে জীবন যাপনের জন্য উঁচু রাস্তায় কিংবা বাঁধের উপর আশ্রয় নিয়ে দুর্বিষহ দিন কাটায়। নদী ভাঙনের মতো দূর্যোগ মোকাবেলায় টেকসই ও স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতি জরুরী হয়ে পড়েছে। তীব্র নদীভাঙন এলাকার পূর্বের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে নদীভাঙন এলাকাগুলোতে ফ্লাড-বেড পদ্ধতিতে বাঁধ নির্মাণ করার মাধ্যমে টেকসই বাঁধ নর্মিাণ করা সম্ভব। ফ্লাড-বেড পদ্ধতিতে বাঁধঁ নির্মাণ করলে যেমনি ভাবে নদীভাঙন স্থায়ীভাবে রোধ করা সম্ভব তেমনিভাবে বাঁধের উপর দিয়ে স্থায়ী রাস্তা তৈরী করে চরাঞ্চলে মানুষের যোগাযোগের এক অন্যন্য ব্যবস্থা তৈরী করা সম্ভব হবে।

অবকাঠামোগত ও কৌশলগত পদক্ষেপসমূহ বন্যা ও নদীভাঙনের জন্য দূর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কিছু কৌশলগত সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারলে জনজীবনে দূর্ভোগসহ গবাদি পশু-পাখি ও ফসলের ক্ষতি কমানো সম্ভব। দূর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কৌশলগত পদক্ষেপ এগুলো হচ্ছে (১)বন্যার পানি বৃদ্ধির আগইে বন্যার র্পূবাভাস ও র্সতকীকরণ তথ্য ও পদ্ধতি জনসাধারণের মাঝে দ্রুত পৌঁছে দিতে হবে; (২) বন্যাকবলিত এলাকাতে বন্যা পরবর্তী ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জনসাধারনকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে (৩) বন্যাকবলিত গ্রামগুলোতে উচুঁকরে বন্যা-আশ্রয়কেন্দ্র তৈরী জরুরীভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এই আশ্রয়-কেন্দ্রগুলোতে বছরের অন্য সময়ে স্কুল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। তাহলে বন্যায় কবলিত শিশুদের স্কুলের পড়া-লেখা বন্ধ হবে না; (৪) বন্যা পরবর্তী চাষাবাদের জন্য ভাসমান বীজতলা তৈরীতে সাহায্য করা (৫) প্রয়োজোনবোধে দীর্ঘ সময় ধরে জলাবদ্ধ এলাকাসমূহে ভাসমান সবজী চাষের জন্য কৃষককে সাহায্য করা; (৬) প্লাবন ভূমিসমূহকে ও তীব্র নদীভাঙন এলাকাসমূহকে বিভিন্ন  জোনে বিভক্ত করা এবং উন্নয়ন র্কমকান্ডের চাহিদা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করার জন্য ভূমি ব্যবহার জোন তৈরী করা (৭) ষষ্ঠভূজ আকৃতির ডিজাইনের ব্লক তৈরী করে নদীভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণ করা  (৮) তীব্র নদীভাঙন এলাকাগুলোতে স্থায়ীভাবে নদীভাঙন রোধে ফ্লাড-বেড পদ্ধতিতে বাঁধ নির্মাণ করা অতি প্রয়োজন।প্রতি বছরই বন্যা হচ্ছে, হয়েছে এবং হবে। কোনোটি হবে মাঝারি আকারের, কোনোটি হবে ভয়াবহ। সব ধরণের বন্যার জন্যই প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। খাল-বিল ও নদীর তলদেশ গভীর খনন করলে বন্যার পানি খাল-বিল ও নদীর পানিসমূহ ধরে রাখার ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, তখন নদীর পানি উপচে পাড়ের দিকে ধাবিত হবে না এবং নদীর পাড় ভাঙনের ভয়াবহতা কমে আসবে। নদী ভাঙন রোধে সিমেন্টের ব্লক পদ্ধতির পরিবর্তে ষষ্ঠভূজ আকৃতি ডিজাইনের ব্লক তৈরী করে নদীভাঙন রোধ করা এবং নদীভাঙন রোধে ফ্লাড-বেড পদ্ধতিতে বাঁধ নির্মাণ করে টেকসই উন্নয়ন করা। বন্যা ও নদী ভাঙনের মতো দূর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারলে জনদূর্ভোগ কমানো সম্ভব হবে। অপরদিকে, খাল-বলি-নদী উদ্ধার ও খনন করে বন্যার পানি ধরে রাখতে পারলে প্রয়োজনীয় সময়ে পানি কৃষি কাজে ব্যবহার, মৎস চাষে উন্নয়ন এবং সর্বপরি পরিবেশ-প্রতিবেশের সহায়ক ভুমিকা পালন করবে। তাছাড়া, দেশের প্রতিটি খাল-বলি-নদী উদ্ধার ও খনন করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নৌপথ তৈরী করে পানিপথে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী উন্নয়ন করা সম্ভব। ঢাকা শহরের চারিদিকে টেকসই নৌপথ চালু করলে শহরের যানজট অর্ধেকে কমে আসবে। তাই নদীগুলোকে সুষ্ঠু ব্যবস্থা ও কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে নদী পরিবেষ্টিত বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়নের পাশাপাশি দরিদ্রতা দুর করা সম্ভব।

(লেখক: মো: হাসিবুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও পিএইচডি গবেষক)