ছবি:সংগৃহীত
প্রাচ্যের ভেনিস বরিশালে রয়েছে অনেক বিখ্যাত নারী। ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে শিক্ষা,চিকিৎসা রাজনীতি ও সাহিত্য অঙ্গনে যাদের রয়েছে খ্যাতি। এখানে জন্মে ছিলেন এমন সব প্রতিভাবান নারী যাদের দু’ একজনের নাম আমরা সবাই জানলেও অনেককেই হয়তো চিনিনা বা জানিনা। আবার নাম শুনলেও আমরা হয়তোবা জানিনা যে তাদের আসল ঠিকানা হচ্ছে বরিশাল। আজকের পর্বে আমরা জানবো বরিশালের কৃতিমান ৫ জন নারী সম্পর্কে।
কাদম্বিনী গাঙ্গুলি:
উনিশ শতকে বাঙালি সমাজে নারীর জীবন যখন ছিল খুবই পশ্চাদপদ এবং বহু প্রতিকূলতায় জর্জরিত, তখন সবরকম সামাজিক বাধার বিরুদ্ধে লড়াই করে ইতিহাস তৈরি করেছিলেন এক বাঙালি নারী, যার নাম কাদম্বিনী গাঙ্গুলি।কাদম্বিনী গাঙ্গুলি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতেই শুধু নয়, উনবিংশ শতাব্দীতে তিনি ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম দুজন নারী স্নাতকের একজন। এবং তিনিই ছিলেন ইউরোপীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানে শিক্ষিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পেশাজীবী নারী চিকিৎসক। বরিশালের গৌরনদীর চাঁদশীতে তার বাড়ি। কাদম্বিনীর জন্ম ১৮৬১ সালে। বাবা ব্রজকিশোর বসু চাকুরি সূত্রে থাকতেন বিহারের ভাগলপুরে, যেখানে তিনি ভাগলপুর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। সেখানেই জন্ম কাদিম্বিনীর। ব্রিটিশ শাসিত দেশগুলো থেকে প্রথম যে দুজন নারী গ্র্যাজুয়েট হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন তারা হলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি এবং চন্দ্রমুখী বসু। কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে ১৮৮৩ সালে তারা দুজনে স্নাতক হন। কাদম্বিনী স্নাতক পাশ করার পর ডাক্তারি পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। এবং তিনিই ছিলেন ইউরোপীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানে শিক্ষিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পেশাজীবী নারী চিকিৎসক।
রাজিয়া বানু :
রাজিয়া বানু বাংলাদেশের সংবিধান রচনা কমিটির একমাত্র নারী সদস্য। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নাতনি রাজিয়া বানুর জন্ম,ও বাড়ি বরিশাল। ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল গঠন করা হয়েছিল ৩৪ সদস্যের সংবিধান রচনা কমিটি । ড. কামাল হোসেন ছিলেন ওই কমিটির সভাপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাজিয়া বানু ছিলেন প্রথম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি সংসদ সদস্য পদে দায়িত্ব পালন করেন।এর আগে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সংরক্ষিত নারী আসনের সাত সাংসদের একজন ছিলেন। তিনি ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি শিক্ষাবিষয়ক সংসদীয় সচিব ছিলেন।
কামরুন্নাহার লাইলী:
কামরুন্নাহার লাইলী ছিলেন আইনজীবী ও রাজনীতিবীদ। তিনিই প্রথম বার কাউন্সিলের মহিলা সদস্য ও বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একমাত্র মহিলা ‘নোটারি পাবলিক’ স্বীকৃতি দেয়। তিনি পিরোজপুর জেলার ডুমুরতলায় ১৯৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন।১৯৫১ সালে পিরোজপুর গালর্স স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং বরিশাল বি.এম. কলেজ থেকে আই.এ. ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে বি.এ.(অনার্স) এবং ১৯৫৭ সালে ইতিহাসে এম.এ. পাশ করেন।ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৫৬ খ্রি. প্রতিষ্ঠিত পাক-চীন মৈত্রী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যা। তিনি ভাষা আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্য তৎকালীন সরকার কর্তৃক ঢাকা থেকে বহিষ্কৃত হন। পরে ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টি ন্যাপ এর সদস্য হিসাবে ১৯৭০ সালে যুক্ত হন। ছাত্রাবস্থায় ১৯৫৭ সালে সাপ্তাহিক ‘অবরূদ্ধা’ ও পরে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর মহিলা বিভাগের সম্পাদিকা ছিলেন। এম.এ. পাশ করার পর ১৯৫৮ সালে আনন্দময়ী গার্লস স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। ১৯৬৩ সালে আইন পরীক্ষায় পাশ করে অ্যাডভোকেট হিসাবে ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট বার ও ঢাকা হাই কোর্টে যোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেত্রী এবং ডাকসুর নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি সুপ্রিয় কোর্টে কর্মরত ও ‘বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী’ সমিতির সভানেত্রী ছিলেন।
কবি কুসুম কুমারী দাশ:
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?
বিখ্যাত এই কবিতার কবি কুসুম কুমারী দাশ ১২৮২ বঙ্গাব্দের ২১ শে পৌষ বাখরগঞ্জ জেলার বরিশাল শহরের “গৈলা” গ্রামের এক বিদ্যানুরাগী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা চন্দ্রনাথ দাস এবং মাতা ধনমণি। তিনি ছিলেন বরিশালের লাকুটিয়া জমিদার বাড়ির পূত্রবধু। কুসুমকুমারী দাশ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি তিনি খুব বেশি লেখালেখি করতে পারেননি। কিন্তু যেটুকু রেখে গেছেন তাতে তার প্রতিভার ছাপ সুস্পষ্ট। তাঁর রচিত “আদর্শ ছেলে”, যার প্রথম চরণ “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে”, বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। দুই পুত্র এক কন্যা সন্তানের জননী ছিলেন তিনি। জ্যেষ্ঠ পুত্র কবি জীবনানন্দ দাশ। আরেক পুত্র অশোকানন্দ দাশ এবং কন্যা সুচরিতা দাশ। কুসুমকুমারী দাশ এর বাবা চন্দ্রনাথ দাশ কবিতা লিখতেন। জন্মসূত্রেই লেখার ক্ষমতা পেয়েছিলেন কুসুমকুমারী দাশ। তেমনি পেয়েছিলেন তার সুযোগ্য পুত্র জীবনানন্দ দাশ।
কবি কামিনী রায় :
কামিনী রায় একজন প্রথিতযশা বাঙালি কবি, সমাজকর্মী এবং নারীবাদী লেখিকা।তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম নারী স্নাতক ডিগ্রিধারী ব্যক্তিত্ব। কামিনী রায়ের জন্ম বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জের উপজেলার বাসণ্ডা গ্রামে। কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে তিনি ১৮৮৬ সালে সংস্কৃত ভাষায় স্নাতক সম্মান ডিগ্রি লাভ করেন। কৈশোরেই কামিনী রায় সাহিত্য রচনা শুরু করেন এবং কবিত্ব শক্তির প্রকাশ ঘটান। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তার প্রথম কাব্য ‘আলো ও ছায়া’ প্রকাশিত হয়। তিনি সেসময় ‘জনৈক বঙ্গমহিলা’ ছদ্মনামে লিখতেন। তার লেখা কাব্যের মধ্যে ‘নির্মাল্য’, ‘পৌরাণিকা’, ‘মাল্য ও নির্মল্য’, ‘দীপ ও ধুপ’, ‘জীবন পথে’ ও ‘শ্রাদ্ধিকী’ উল্লেখযোগ্য। অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত ‘মহাশ্বেতা’ ও ‘পুণ্ডরীক’ তার দু’টি প্রসিদ্ধ দীর্ঘ কবিতা। এছাড়াও ১৯০৫ সালে তিনি শিশুদের জন্য ‘গুঞ্জন’ নামের কবিতা সংগ্রহ ও ‘বালিকা শিক্ষার আদর্শ’ নামের প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করেন। ১৯২৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কামিনী রায়কে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক দেয়। তিনি ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় লিটারারি কনফারেন্সের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।