ছবি:সংগৃহীত
রাজধানীর অভিজাত এলাকায় এমন এক বাড়িতে গিয়েছিলাম, এমন পুরনো দৃষ্টিনন্দন ভবন ঢাকা শহরে এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন। পেশাগত জীবনে আর ব্যক্তিজীবনের সফলতা একই মাপকাঠিতে পরমিাপ করা সহজ নয়! ষাট বছরের কাছাকাছি বয়সি নাইমা আমীন। মনে হলো সঙ্গে করে যেন নিয়ে এলেন এক পরিপাটি শান্ত সৌম্য আবহ। পরিপাটি বসার ঘরে আসবাবের অনেকগুলোর বয়স তারই সমান।
পেশাগত জীবনে ব্যাপক সফলতা পান নাইমা আমীন। বছর কয়েক আগ পর্যন্ত দেশি বিদেশি বহু উন্নয়ন সংস্হায় গবেষণার কাজ করেছেন।বলা যায় এখন পুরোদস্তর কৃষক। পরিবারের জমিতে ফসল ফলান, মাছ চাষ করেন। বছরের বড় সময় কাটান গ্রামের বাড়িতে। কেন কখনো বিয়ের পিঁড়িতে বসা হলো না, সেই গল্প করেন নাইমা। তিনি বলেন, ‘প্রথম আমার মনে হয়েছিল, আমি সেটল ম্যারেজ করব না !কথা শুরু হতেই হাসিমুখে জানালেন চিরকুমারী জীবন কেমন চলছে। তিনি বলেন,বিয়ে না করার সবচেয়ে বড় এক্সাইটিং পার্ট হলো আমার কোনো বাইন্ডিংস নাই। আমার কোনো চিন্তা নাই। আমার একটা লিবার্টি আছে ‘আমি খুবই সুখী এখন পর্যন্ত।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব সমাজে একজন নারী নির্দিষ্ট একটি বয়সে বিয়ে করবেন,সংসারী হবেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্ম দেবেন- এটাই প্রচলিত নিয়ম। পশ্চিমা বিশ্বের নানা দেশ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া-এমন অনেক দেশে অবশ্য নারীদের একটি অংশ এখন ভিন্নভাবে চিন্তা করছেন। বাংলাদেশেও রয়েছে এমন অনেক চিরকুমারী,যারা নিজের ইচ্ছায় অথবা পারিপার্শ্বিক কোনও কারণে কখনই বিয়ের পিঁড়িতে বসেননি।কেমন তাদের জীবন? সমাজ কিভাবে দেখে?
১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পাস করার পর থেকে পেশাগত জীবনে ব্যাপক সফলতা পান নাইমা। বছর কয়েক আগ পর্যন্ত দেশি বিদেশি বহু উন্নয়ন সংস্হায় গবেষণার কাজ করেছেন। এখন পুরোদুস্তর কৃষক। পরিবারের জমিতে ফসল ফলান,মাছ চাষ করেন। বছরের বড় একটা সময় কাটান গ্রামের বাড়িতে। কেন কখনো বিয়ের পিঁড়িতে বসা হলো না, সেই গল্প করেন নাইমা।তিনি বলেন, ‘প্রথম আমার মনে হয়েছিল,আমি সেটল ম্যারেজ করব না। মা-বাবা আমার জন্য খুব ভালো ভালো প্রস্তাব এনেছিলেন।আমি তখন প্রতিবাদ করলাম যে, না তোমরা তো আমাকে জিজ্ঞেস করোনি। যে কয়টা প্রস্তাব এসেছে সবই ভালো ছিল। বয়োজ্যেষ্ঠ এ নারী বলেন, ‘আমি পরিবারের খুব বাধ্য মেয়ে ছিলাম।আমি যে কখনো মা বাবার অবাধ্য হবো, তাদের ধারণাই ছিল না। এর মধ্যে মাস্টার্সের রেজাল্ট বের হলো। তখন আমি চাকরিতে ঢুকে গেলাম। এরপর যখনই বিয়ের প্রস্তাব আসছে, আমি পিছিয়ে যাচ্ছি। তখনই আমার মধ্যে একটা জিনিস ঢুকে গেল যে আমার স্বাধীনতা থাকবে না।’
যে সময়ের কথা নাইমা বলেছেন, সেই সময়ে বিয়েতে এমনি সরাসরি না বলা ছিল ঔদ্ধত্যের মতো। উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া, শিক্ষা ও পেশায় পরিবারের অবস্হানের কারণে তিনি উৎরে গেছেন। তার মা-বাবা কখনই তাকে চাপ দেননি।তবে বিয়ে না করার সিদ্ধান্তে কষ্ট পেয়েছেন।ঢাকার আরেক প্রান্তে দেখা হলো কোনো দিন বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এমন আর একজনের সঙ্গে। বাবা-মায়ের মধ্যে দীর্ঘদিনের তিক্ত সম্পর্ক দেখে বৈবাহিক জীবন সম্পর্কে ভীত হয়ে ওঠেন তিনি। সবে ৫০বছর পূর্ণ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার করার পর থেকেই বড় যৌথ পরিবারে থাকছেন।বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়,চিরকুমারী নারীগন বয়স্ক মা-বাবা ও নানির দেখাশোনা করেন। ভাগ্নে, ভাস্তিদের সঙ্গে সময় কাটান। তাঁদের কেউ কেউ চাকুরি,ওষুধের ব্যবসা করেন। কিন্তু বাংলাদেশে তার মতো চিরকুমারী নারীর চলার পথ সবসময় মসৃণ নয়।সবচেয়ে বেশি হজম করতে হয় আত্মীয়দের কথার চাপ। সেটার বর্ণনা করে তিনি বলছিলেন,‘দেখা যায় পারিবারিক প্রোগ্রামে গেলে আত্মীয়স্বজনরা প্রতিবারই বিয়ে প্রসঙ্গে নানান কথা জিজ্ঞেস করে। তখন আমার পরিবার বিব্রতবোধ করে। কোনো না কোনোভাবে তাদের দোষ দেয়া হয়। তারা চেষ্টা করে নাই বা কী করছে।’ যুবতী এ নারী বলেন, এই কারণে আমার আত্মীয়দের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। আমার চাচির পরিচিত ডাক্তারের কাছে গেছি। সে আমাকে বলছে, আমি কেন বিয়ে করিনি। তাই আমার বোনের বিয়ে হচ্ছে না! এটা শুনে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। আমি ভালো জায়গায় পড়াশুনা করেছি। কারো ওপর নির্ভর করতে হয় না।কিন্তু আমাকে শুনতে হয়- ভবিষ্যতে আমাকে কে দেখেশুনে রাখবে, যেহেতু বিয়ে করিনি ছেলে-মেয়ে নেই। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষজন খুব সহজেই ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে! পাড়ার সবজিওয়ালা, বাড়ির কাজের লোক যে কেউ জিজ্ঞেস করে ফেলে স্যার কি করে, বাচ্চা কয়জন?এইতো সেদিনও আম্মাকে নিয়ে হাসপাতালে গেছি। নার্সরা যখন শুনেছে বিয়ে করিনি,তখন জিজ্ঞেস করা শুরু করলো কেন বিয়ে করিনি,এখনো করা উচিৎ, পরে কি হবে ? প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও থেকে এসব উপদেশ শুনি!যেটা খুব বিরক্তিকর, বিব্রতকর আমার জন্য।বিষয়টা ব্যাখ্যা করলেও আসলে তারা বোঝে না।’আরো বেশি বিব্রত হতে হয়, যখন ব্যাখ্যা না জেনেও চারপাশে গুঞ্জন চলে।
চেহারার কারণে বিয়ে হয়নি। নিশ্চয়ই কোনও সমস্যা আছে অথবা ছ্যাঁকা খেয়েছে। যখন আইবুড়ো সম্বোধন নিতে হয়, চরিত্র নিয়ে সন্দেহের মুখে পড়তে হয়।পুরুষ প্রতিবেশী, সহকর্মী, বন্ধুদের কাছ থেকে অশোভন প্রস্তাব আসে। যেমনটা বলছিলেন একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী একজন। তিনি বলেন, ‘আমাকে আমার এক সহকর্মীর স্ত্রী সন্দেহ করতো। কোনোভাবেই আমি বোঝাতে পারতাম না যে, তার স্বামীর প্রতি আমার কোনও আগ্রহ নেই। সহকর্মীদের কেউ কেউ ধরেই নেয় যে আমার সঙ্গে চাইলেই কিছু করা যাবে! বাসায় কোনও পুরুষ সহকর্মী বা বন্ধু বেড়াতে এসেছে। দেখা গেল তখন বাড়িওয়ালা বা দারোয়ান প্রশ্ন করছে। তার সম্প্রদায় খুব ছোট হওয়াতে মনের মতো কাউকে কখনই পাননি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে কয়জন খ্রিস্টান আছে বলুন? খ্রিস্টানদের মধ্যেও আবার সেক্টর আছে। এর মধ্যে থেকে আমার বয়সি পাত্র কয়জন আছে? আমার পরিবার আমার জন্য যাদের নিয়ে এসেছে, তাদের কাউকে আমার মনে হয়নি ওদের সঙ্গে আমি জীবন কাটাতে চাই।’এই এনজিও কর্মী আরও বলেন, ‘এই কয়টা খ্রিস্টান ছেলের মধ্যে আমি ভালোবাসার মতো কাউকে পাইনি। আমি যে পর্যায়ে আছি পেশাগত জীবনে সেদিক দিয়েও আমার ধারে কাছে কেউ নেই। ভালোবাসা না থাকলে আমার চেয়ে কত অযোগ্য পুরুষকে আমি বিয়ে করতে পারি?’ অবিবাহিত এমন নারীদের বাড়ি ভাড়া করতে গিয়ে প্রায়ই বাড়িওয়ালাদের নানান কথা শুনতে হয়। তাই বাধ্য হয়েই অনেকে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে থাকেন। বিয়ে না করলে গ্রামীণ নারীদের আরও বেশি সমস্যার মুখে পড়তে হয়।বিয়ে না করার কারণে অপয়া বলা হয়!! পরিবারের বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে দূরে রাখা হয় এমন ঘটনাও ঘটে প্রচুর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন বলেছেন, বিয়ে না করে জীবন কাটানো নারীদের সমাজ অবাধ্য মনে করে।স্বাধীনচেতা নারীকে সমাজ খারাপভাবে দেখে।কারণ, সে কাঙ্খিত নারী চরিত্র থেকে বাইরে যাচ্ছে। এসব কারণে সমাজ ও পরিবার তার প্রতি বিরূপ আচরণ করতে থাকে প্রশ্ন করতে থাকে। তার ভাষায়, নারী বিয়ে না করলে সে অনেকভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। নারীকে পরিবার সবচেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণের রাখতে চায়। বিয়ে না করলে পরিবার মনে করে সে কথা শুনছে না।বিয়ে করে যৌনতার আবদ্ধ হওয়া, সন্তান ধারণ এবং একটি উত্তরসূরি দেয়ার যন্ত্র হওয়া, এগুলো সে করছে না। পুরুষের বাধ্য হচ্ছে না। সমাজ তাকে যেভাবে দেখতে চায়, বিয়ে না করলে সে সমাজ নির্ধারিত খোপের মধ্যে ঢুকছে না। এমন নারীরা প্রায়শই পরিবারেই অসম্মান,অবহেলা, নিগ্রহের শিকার হন। তবে সমাজের কথার ঝাঁঝ, বাঁকা দৃষ্টি পরোয়া করেন না নাইমার মতো অনেকেই। তিনি বলেছেন, ‘আমি কোনো দিন কিছু গায়ে মাখিনি। যখন কেউ একদিন বলছে দুইদিন বলছে, তারপর যখন দেখছে,কোনও সাড়া নেই, তখন তারা আপনাআপনি চুপ হয়ে গেছে। আমার গ্রামের মানুষজন আমাকে অসম্ভব সম্মান করে।’ এটা আমার
ভালোলাগা এক অনুভূতি।