রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ভাদ্র ২৩ ১৪৩১

শরৎ এলো কাশবনে

আলম শামস

প্রকাশিত: ০৮:৩৭, ১৭ আগস্ট ২০২২

শরৎ এলো কাশবনে

ছবি:সংগৃহীত

গ্রীষ্মের ঝড়-তুফান আর বর্ষার অঝোর ধারার বৃষ্টি ও বন্যা, মধু মাসের রসালো ফলের সুভাসিত মিষ্টি আমেজ যেতে না যেতেই প্রকৃতিতে এসে হাজির শরৎ। ষড়ঋতুর দেশ আমাদের বাংলাদেশ। ভাদ্র ও আশ্বিন মিলে শরৎকাল। বর্ষার শেষ দিকে বাংলার আকাশে সাদা মেঘের আনাগোনা চোখে পরে। আর কাশবনে কাশফুল ফোটার মোহনিয় আমেজ শরতের আগমনকে জানান দেয়। শুভ্র সাদা কাশফুলে কোমল পরশ, নরম ছোয়ায় ভরে ওঠে হৃদয়। কাশবন ও শরতের আকাশ প্রকৃতিতে আনে এক মোহনীয় আমেজ। এ সময়ের সিগ্ধ শান্ত কোমল পরিবেশ হৃদয়ে সৌরভ ছড়ায় আর বাহারী শিউলি ফুলের মিষ্টিআমেজ মানব মনে স্বপ্নিল অনুভূতি জাগায়। প্রকৃতি সাজেসবুজের সমারোহে।

শরতে নদী-বিল বা হাওড়ের স্বচ্ছ পানির বুকে নানা রঙয়ের শাপলার মন মাতানো হাসি সবারই মনকাড়ে। শরতের আকাশে শুভ্র সাদা মেঘের ছুটাছুটি আমাদের চোখ জুড়ায়। মেঘগুলো বাতাসে ভেলার মতো আকাশে ওড়ে বেড়ায়। ছুটে যায় একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। মেঘে মেঘে হাতাহাতি হয়। এক টুকরো মেঘ ঢুকে পড়ে আরেক টুকরোর মধ্যে। কখনওবা মেঘের ঘর্ষণে বৃষ্টি নামে। অঝোর ধারায় বৃষ্টি। ঠিক বর্ষাকালের মতো।তারপর আবার কোথায় যেন উধাও হয় মেঘ। আকাশ পরিষ্কার হয়ে সূর্য প্রচণ্ড রোদ ছড়ায়। তেতে ওঠে বাংলার মাঠ ঘাট। ভ্যাপসা গরমে আবার হা-হুতাশ শুরু হয়। দেখতে দেখতে মেঘের আকাশ আবার গভীর নীল আভায় ভরে যায়। টুকরো টুকরো মেঘগুলো ভেসে যায় নীল গগনের ওপর দিয়ে। যেন মেঘের ফাঁকে নীল হাসে। এই দৃশ্য দেখতে
কার না ভালোলাগে। এতে মনের ক্লেদ দূর হয়। অশান্তিটা সরে যায়। মন এক সফেদ সুখের আমেজে ভরে ওঠে।শরতে খাল-বিলের স্বচ্ছ পানিতে কচুরিপানার বেগুনি ফুল ফোটে। হাজারো ফুল। যেন ফুলের রাজ্য। চোখজুড়ানো ফুলের হাসি মনকে আলোড়িত করে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এই ফুল তুলে আনেগভীর আনন্দে। গাঁয়ের ছোট্ট মেয়েরা খোঁপায় ফুল বেঁধে সুখ পায়।

কাশফুলের নয়নাভিরাম দৃশ্য শরৎকে করে প্রাণবন্ত। কাশফুলের মোহনীয় সৌন্দর্য সবার মন কাড়ে। কাশফুলের স্নিগ্ধ হাসি মানুষের মনে ছড়ায় আনন্দ। নদীমাতৃক বাংলাদেশকে ঘিরে আছে ছোটবড় শত শত নদী। এসব নদীর তটজুড়ে বিশাল কাশবন। এ যেন সাদা ফুলের বাগান। নরম বাতাসে কাশফুল দুলতে থাকে। দোলে শিশুর দোলনার মতো। সাদা সাদা ফুলের এই দোলায় মন দোলে। কাশফুলের মনমাতানো দোলায় মনের গভীরে সুখ নেচে ওঠে। নদীর পানিতে গিয়ে লাগে সেই দোলা। ফলে দুলতে থাকে নদী। নদীতে যেসব নৌকা চলে তাও দুলে ওঠে। দুলে ওঠে মাঝির মন। তখন মাঝি মনের সুখে গান ধরে। ভাটিয়ালি গান। জারি গান। পল্লীগীতি। গানের সুর আর ফুলের হাসি মিলে নদীর চরে জাগে সুখের উন্মাতাল। এ সময় চরের চাষির মনও নেচে ওঠে। রাখালের মুখে মুখে বাজে গুণগুণ গান। সবমিলে সুখের এক রাজ্য গড়ে ওঠে আমাদের দেশে। শরতের হাত ধরে এই যে মায়াবি দৃশ্য জাগে তা কখনও ভুলবার নয়। শরতের সকাল নিয়ে আসে অফুরন্ত সুখ আর আনন্দ। গাছের পাতায়,ফুলের পাপড়িতে জমা শিশিরের ওপর সকালের কাঁচা রোদ পড়ে চিকচিক করে ওঠে। শিশিরভেজা ঘাসের ওপর হাঁটতেই পা ভিজে যায়। শিশিরের নরম ছোঁয়া পায়ে মৃদুমন্দ শিহরণ জাগায়। আর এই শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেহে। এতে মনের শরীরও ভিজে যায়। তখনমনে যে সুখ লাগে তা মনকে সারাদিন সতেজ রাখে।

তালের মিষ্টি গন্ধে শরৎ আসে। ভাদ্রের তাপে তাল পাকে। তালের মধুর ঘ্রাণ মনকে সতেজ করে। তালের পিঠার মজাই আলাদা। গ্রাম-শহরে বিকেলবেলায় তালের পিঠা খেতে অনেকেই আনন্দ পায়। গাঁয়ের বউয়েরা অনেক যত্ন করে বানায় তালের পিঠা। বিকেলের গল্পের আসর জমে তালের পিঠা খেতে খেতে। শিউলি ফুলের পাপড়িতে চড়ে আসে শরতের সকাল। শিশিরভেজা সকালে শিউলি ফুলের গন্ধ মনকে ওতলা করে তোলে। এমন সময় বকুলতলায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে শরৎ। বকুলের সৌরভ কাছে ডাকে। বকুলের ঝরা ফুল স্বপ্নের চাদর বিছিয়ে রাখে। বকুল ফুলের চাদর মাড়িয়ে হাঁটতে খুব ভালো লাগে।

শরতের বিকেল মায়াবি আদর ছড়ায় মনের গহীনে। দুপুরের রোদ তখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এর ঝাঁঝ কমে যায়। শীতল হয়ে ওঠে বিকেলের পরিবেশ। তখন গাছগাছালির শিরে আলতো চুমু খায় বিকেলের নরম রোদ। ঘন সবুজ বনানীর ওপর নরম রোদের ছোঁয়া আমাদের মনকেও নাড়া দেয়। এই মায়াবি সুখের আমেজ কাটতে না কাটতে নেমে আসে হালকা শীতল সন্ধ্যা। ধীরে ধীরে রাত গভীর হয়। হালকা গরম আর হালকা ঠান্ডার আমেজে রাতে ঘুম ভালো হয়। সকালে আবার সূর্য ওঠে শিশিরে ভিজে। মানুষ আবার ব্যস্ত হয়। কাজের সন্ধানে ছুটে চলে মানুষ। ছেলেমেয়েরা যায় পাঠশালায়। চাষি ছুটে খেত-খামারে। সারাদিন ব্যস্ততার পর আবার মানুষ ফিরে আসে আপন ঠিকানায়।শরতের সুখ মেখে এভাবেই কাটে এ দেশের মানুষের জীবন। ছন্দময়,গতিময় এক অনাবিল শান্তির ঋতু শরৎ। এই শরতে আমাদের মন আন্দোলিত হয় বারবার। প্রতিবছর আমরা শরতের শিশির মেখে মন জুড়াই।

শরতের এই বিমহিত সুখকর পরিবেশ সুবাসিত সৌরভে বারবার ছন্দে ছন্দে বলতে ইচ্ছে করে -
বর্ষা গেল বৃষ্টি গেল
শরৎ এলো আজ
হরেক রকম ঢঙে এখন
পল্লী গাঁয়ের সাজ।

আকাশেতে সাদা মেঘের
এলো মেলো খেলা
রোদ মেঘের লুকোচুরি
দেখে কাটে বেলা।

বিলের মাঝে শাপলা শালুক
নতুন নতুন ফুল
মিফতা মনি তুলতে যাবে
বাঁধছে এখন চুল।

শিউলি ফুল মন মাতানো
ছড়ায় সুবাস গন্ধ
কবিরা সব লিখতে বসে
খুজে বেড়ান ছন্দ।