লেখক সাংবাদিক-পি আর প্ল্যাসিড
নব্বইয়ের দশকে জাপানের অর্থনৈতিক অবস্থা যখন চাঙ্গা তখন পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নয়নশীল এবং নিম্নআয়ের দেশগুলো থেকে জাপানে কাজের সন্ধানে দলে দলে লোক আসতে শুরু করে। বাংলাদেশ থেকেও সেই সময় কম লোক আসেনি। যদিও আমি সেই সময়েই আসা একজন তারপরেও আমার আসাটা অন্যদের মতো স্রোতে ভেসে আসার মতো ছিল না। আমি জাপান আসার সময়টাও প্রায় একই হওয়ায় সেই সময়ের অনেক কিছুই আমি নিজের চোখে দেখেছি। সেই সময়কার অনেক ঘটনা আমার চোখের সামনে ঘটার কারণে এখনো সেসব ঘটনার কথা আমার মনে শক্ত করে বাসা বেঁধে রয়েছে। এ অভিজ্ঞতাগুলো আগামী প্রজন্মের জন্য লিখে রেখে যেতে চাই। যে কারণে শুরু করেছি ‘জাপানে বাংলা ও বাঙালি’ শিরোনামে অনেক বড় লেখা। লেখাটিতে আমার অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতার কথাই লেখা থাকবে যা আগামী প্রজন্ম পড়ে জানতে পারবে জাপানে বাঙালিদের শুরুর দিকের জীবনযাত্রা কতোটা কঠিন ছিলো।
আমি যে সময় জাপান এসেছি তখন এখানে বাঙালিদের বলার মতো একটি মাত্র সংগঠন ছিল, যার নাম ‘বাংলাদেশ সোসাইটি জাপান’। এখন এটি বিলুপ্ত প্রায়। উক্ত সংগঠনটি তখন টোকিওতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সাথে সমন্বয় করে প্রবাসীদের দ্বারা এবং প্রবাসীদের জন্য নানা কর্মকান্ড করতো। যে কারণে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের শাখা প্রশাখা বা অঙ্গসংগঠন দেখা যায়নি। প্রয়োজনও ছিলো না তখন। পরবর্তীতে আমি আসার বেশ কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধু পরিষদ আর জিয়া পরিষদ নামে আলাদা আদর্শের দুটি সংগঠনের জন্ম হয়েছে এখানে। এ'দুটি সংগঠনই বেশ দাপটের সাথে শুরুর দিকে বাঙালি কমিউনিটিতে নানা ধরনের রাজনৈতিক কর্মকান্ড করেছে টোকিওতে।
বর্তমানে জাপানের বিভিন্ন প্রিফেকচারে যেখানে আড্ডা দেবার মতো বাঙালির বসবাস সেখানেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সংগঠন। এমনকি বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর শাখা, প্রশাখা, অঙ্গ সংগঠন ছাড়াও ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, আঞ্চলিক নানা সংগঠন সহ আরো অনেক ধরনের সংগঠনেরই জন্ম হয়েছে জাপানে। এগুলোর বেশিরভাগ সংগঠনের ক্ষেত্রে পদ পদবী নিয়ে বা মতের অমিলের কারণে কতিপয় লোক আলাদা করে নিজেদের নাম আর আধিপত্য দেখাতে ভিন্নভাবে সংগঠন করে মূল সংগঠনের পাশাপাশি তারা নিজেরাও কর্মকান্ড শুরু করেছে। এ-সবই যেন স্বাভাবিক বিষয় এখানে।
এতো সব সংগঠন থাকার পরেও জাপান-বাংলা ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি নামের একটি এনপিও (নন প্রফিটাবল অরগানাইজেশন) এখন থেকে প্রায় দুই যুগ আগে টোকিওর তোশিমা ওয়ার্ডস্থ ইকেবু্যকোরো রেল স্টেশন সংলগ্ন নিশি গুচি পার্কে শুরু করেছিল বৈশাখি মেলার। শুরুতে হাতে গোনা মাত্র (সম্ভবত) ৫টা কি ৬টা স্টল ছিল। সবগুলো স্টলই ছিল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক উদ্দেশে। শুরুতেই সবাই বৈশাখি মেলায় স্টল দিয়ে ব্যবসায়িক সফলতা পেয়েছে। তার মধ্যে আমি একটা স্টল দিয়েছিলাম বই প্রদর্শণীর। সত্যি কথা বলতে আজকের মতো জাপানে সেই সময় বাংলা বই, পত্র-পত্রিকা তখন এতো সহজ লভ্য ছিলো না। তাই বিভিন্ন জনের কাছ থেকে বাংলা বই সংগ্রহ করে প্রথমবার টোকিওতে বর্তমান মেলার যাত্রা শুরুর কালে আমি সব কিছুর সাথে সংযুক্ত হয়েছিলাম সাহিত্য প্রেমিদের জন্য স্টলে বই প্রদর্শণ করে। আমি বইয়ের স্টল দেওয়ায় আমার স্টল এই মেলাকে শুরু থেকেই ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে।
চাইলেই আমি শুরুতে মেলায় অন্যকিছুর স্টল দিয়ে বাড়তি টাকা রোজগারের চিন্তা করতে পারতাম। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল আমাকে অবশ্যই অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম কিছু করতে হবে। যে কারণে পরের বছর এই বৈশাখি মেলা উপলক্ষে ঢাকা থেকে খ্যাতিমান লেখক নাট্যকার ইমদাদুল হক মিলনকে আমন্ত্রণ জানাই। মিলন ভাইকে ফোন করে এমন প্রস্তাব করলে তিনি জানালেন তাকে আমন্ত্রণ জানাতে হলে আমাকে দেশে যেতে হবে। দেশে গিয়ে সামনাসামনি বিস্তারিত বলতে হবে।
ইমদাদুল হক মিলনের মতো এতো বড় মাপের লেখককে আমন্ত্রণ করে খরচ দিয়ে জাপান নিয়ে আসার মতো কোনো বাড়তি উপার্জন তখন আমার নেই। তবু ইমদাদুল হক মিলনের প্রতি আমার ভালোবাসায় টাকার জন্য থেমে থাকার মতো ছিলো না। তাই চলে গেলাম দেশে। দেশে গিয়ে তার বাসা পর্যন্ত গিয়ে তাঁকে বিস্তারিত বলে রাজি করিয়ে তাঁর জাপান আসার সব ব্যবস্থা করে ফিরে আসি জাপান। সেবছর ইমদাদুল হক মিলনকে আমি টোকিও থেকে প্রকাশিত ও সম্পাদিত বাংলা মাসিক ম্যাগাজিন বিবেক এর নাম অনুসারে বিবেক সাহিত্য পুরষ্কার প্রদান করি।
টোকিওতে বৈশাখী মেলা নাম দিয়ে প্রতিবছর বাঙালিদের সবচেয়ে বড় আয়োজন পহেলা বৈশাখ উদযাপন করলেও পরবর্তীতে এর সাথে যোগ করা হয় কারি ফ্যাস্টিভ্যাল। এখন এটি টোকিও বৈশাখী মেলা ও কারি ফ্যাস্টিভ্যাল নামেই পরিচিত।
কেউ আজকের এই সময়ে এসে স্বীকার না করলেও সত্য যে, আমি প্রথম এই মেলা উপলক্ষে দেশ থেকে নিজের খরচে একজন ভিআইপি গেস্টকে আমন্ত্রণ জানাই। শুধু তাই নয়, জাপানে বাঙালি কমিউনিটি থেকে আমিই প্রথম কাউকে অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার প্রচলন শুরু করি। তারপর থেকেই এখন বৈশাখী মেলা কমিটি বিভিন্ন জনকে উত্তরীয় দিয়ে সম্মাননা জানাচ্ছে। যারা লেখালেখি করছেন তাদেরকেও দেওয়া হয়েছে সম্মাননা। অথচ শুরু থেকে এই মেলার সাথে একটি পিলার হিসেবে জড়িত থেকে মেলার একটি পিলার হয়ে গেলেও আমার বিষয়টি যেন সংশ্লিষ্টরা দেখেও না দেখার ভান করছেন। আমি যে টোকিওতে কিছু একটা করছি সেটা তাদের একদম অজানা মনে হয়। এমনকি জাপানের প্রথম অনলাইন বাংলা নিউজ পোর্টাল আমারই। সেখানে তাদের নিউজ প্রকাশ হলেও তারা জানেই না আমার নানা কর্মকান্ডের কথা। অনেকটাই ইচ্ছে করে এড়িয়ে যাওয়ার মতো। আমিও আর এটা নিয়ে কিছু বলি না। বলার আর ইচ্ছেও নেই। কারণ যে যেভাবে করে শান্তি পায় পাক। আমি আমার মতো কাজ করে গেলে তার ফল একদিন পাবোই মনে করি।
এই বৈশাখী মেলা উপলক্ষে খ্যাতিমান লেখক কলামিস্ট আনিসুল হককেও আমন্ত্রণ জানিয়েছি। শুধু তাই নয়, এখানে আরো অনেক বড় বড় রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, লেখক, সাংবাদিকের পদচারণা হয়েছে। এটাই টোকিও বৈশাখি মেলার আজকের অর্জন। এই মেলার মাধ্যমেই মেলাস্থলে আমাদের জাতীয় শহীদ মিনারের আদলে ছোট করে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। যা এখন টোকিওতে ইতিহাস।
প্রতিবছর বৈশাখী মেলায় আমার অংশগ্রহণ থাকে। দেখা যায় আমি অন্য কোনো কাজে দেশে গিয়েছি অথচ মেলায় অংশ নেবার জন্য আগের দিন হলেও দেশ থেকে চলে এসেছি মেলায় উপস্থিত থাকার জন্য। এটা একান্তই বৈশাখী মেলার প্রতি আমার ভালোবাসা থেকে করা হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে নানা কারণে আমি এ থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলছিলাম। আমার স্ত্রী সন্তান আর চায় না আমি এসবের সাথে আর জড়াই। কারণ শরীর মন অর্থনীতি কোনোটাই আগের মতো অনুকূলে নেই।
বর্তমান মেলার আগেও কয়েকজন টোকিওতে এই বৈশাখী মেলা শুরু করেছিল, বেশিদূর আর তারা চালিয়ে নিতে পারেনি। এপর্যন্ত টোকিও বৈশাখী মেলা এবং কারি ফ্যাস্টিভ্যাল উপলক্ষে দেশ থেকে অনেক নামিদামি শিল্পী এবং পারফর্মার এসেছেন। যে কারণে ক্রমেই এই মেলা জাপানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রাণের মেলায় পরিণত হয়েছে। জাপানে যারা কাজ ছাড়া অন্য আর কিছু বোঝে না তারাও এখন মেলার দিন নির্ধারণ করলে কাজের জায়গাতে ছুটি করে মেলায় অংশ নেয়।
জাপানের বিভিন্ন পত্রপত্রিকাসহ ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়ায় প্রচার পাবার কারণে এই মেলা এখন আর শুধুই বাঙালির মেলা নয়, এখানে অংশ নেয় অন্যান্য দেশের লোকজনসহ জাপানিরাও। সুতরাং এটা হয়ে উঠেছে মাল্টি কালচারের আয়োজন। একদিনের কয়েক ঘন্টার মেলায় যারা নানা কিছুর স্টল দেন তাদের ব্যবসা ভালো হওয়ায় স্টল দেবার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে প্রতিবছর মেলার আগে।
২০১৯ সালে মেলার স্থানে উন্নয়ন কাজ চলার কারণে কাছেই ভিন্ন স্থানে মেলা হয়েছিল। সেখানেও ছিল উপস্থিতির সংখ্যা অনেক বেশি। এরপর করোনার কারণে দুবছর মেলা স্থগিত রাখা হয়। এবছর ২০২২ এ করোনার কারণে এবং স্থান না পাওয়ায় আগামী ৮ মে মেলা অনুষ্ঠিত করার প্রস্তুতির কাজ চলছে। আশা করছি এবছর জাপানে যারা সম্প্রতি নতুন এসেছে তাদের জন্য হবে ভিন্ন মাত্রার আয়োজন। দেশের বাইরেও যে বাঙালি তাদের সংস্কৃতি ধরে রাখছে, এটাও যে সম্ভব সেটা দেখে অনেকের হয়তো ঘোর ভাঙ্গবে। যারা এই বৈশাখী মেলাকে দেশে বিদেশ ধর্মীয় লেবাস পরিয়ে ভিন্ন অর্থ করে বন্ধ করতে বলার চেষ্টা করছে কিছুটা হলেও তারা বোঝার সুযোগ পাবে বাঙালির বাঙালিত্বকে কোনো ধর্মের লেবাস দিয়ে দাবিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। সেটা দেশের মাটিতেই কি, বিদেশের মাটিতেই কি। বাঙালি সর্বত্রই বাঙালি। অন্যায়ের কাছে মাথা নতো না করার জাতি।
কারণ দেশের বাইরে জাপানের রাজধানী টোকিওতে এই বৈশাখী মেলা এবং কারি ফ্যাস্টিভ্যাল আমাদের সাংস্কৃতিরই প্রতিনিধিত্ব করছে। দেশে কতিপয় লোক ভিন্ন ধরনের শিক্ষায় শিক্ষা লাভ করায় আমাদের বাঙালির সাহিত্য সংস্কৃতিকে ভিন্নভাবে মূল্যায়িত করার চেষ্টা করলেও এখানে সেটা করার তেমন সুযোগ পাবে না। উল্টো ভুলটা তাদের ভাঙ্গতে সক্ষম হবে জাপানের টোকিওতে বৈশাখী মেলায় এসে নিজের চোখে দেখার ফলে।
পি আর প্ল্যাসিড: জাপান প্রবাসী লেখক সাংবাদিক।