শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, পৌষ ৭ ১৪৩১

বাবা কে নিয়ে আমার স্মৃতিচারণ

সৌম্য দে

প্রকাশিত: ০৯:১৭, ১৫ এপ্রিল ২০২২

আপডেট: ০৯:৩৭, ১৫ এপ্রিল ২০২২

বাবা কে নিয়ে আমার স্মৃতিচারণ

প্রতিকী ছবি

শিশুতোষে বাবা একটি হেলিকপ্টার কিনে দিয়েছিলেন।আমি ভোঁ ভোঁ করে মায়ের চারপাশ ঘুরতাম।ভাবতাম মা–ই আমার আকাশ…মা আনন্দে হাসতেন।বাবা হাতের তালুতে মুখ মুছে আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন বিড়বিড় করে বলতেন ।আমার দুরন্তপনা দেখে নীলু মাসি হাঁপসে উঠতো ।তিনি বলতেন…এমন দস্যি নাকি দ্বিতীয়টি নেই ।সন্ধ্যেবেলা পড়তে বসলেদিদির ফ্রকে কার্টুন আঁকতামক্লাসের খাতায় কাটিকুটি করে ভেস্তে দিতাম তার অঙ্কের অনুশীলন ।পরদিন দিদি তার ক্লাশ টিচার প্রহ্লাদ স্যারের বেতের বাড়ি হজম করে এসে জখম হাতে আমায় খাইয়ে দিতেন আয়ু ভাত ।বাবাকে মনে হতো রুগ্ন পায়ের হাঁ মুখো পাখযার ডানায় ক্লান্ত পালক ঘাড়ে লোম ঝরা আয়ুর অভিশাপ ছলছল চোখ আয়ত নীলচে রঙ ।বাবার অনেকগুলো দুঃখ মাকে নতুন শাড়ি না দিতে পারার দুঃখদিদিকে তালি দেওয়া ফ্রক পরে স্কুলে পাঠানোর দুঃখ আমাকে খেলনা কিনে দিতে না পারার দুঃখ ।এতোগুলো দুঃখ নিয়েও বাবা কোনদিন জাতীয়করণের প্রক্রিয়ায় বিক্রি হয়ে যাননি ।হতাশার কন্টেইনারে মুখ লুকিয়ে চিরস্থায়ী মিউজিয়ামেমাথা রাখেন নি ।জৌলুসহীন দুটি জামায় তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন দীর্ঘ বছর ।মা টিফিনক্যারিয়ারে নুনহীন আলুমাখা ভাত দিতেন দুপুরে বাবা যখন খেতে বসতেন চোখে মুখে কি তৃপ্তির ছাপ !খিদে পেটেই হয়তো জীবন্ত অনুভূতি ধরা দেয় ।

পহেলা বৈশাখে বাবার জন্মদিন ।আমাদের আনন্দের শেষ ছিলো নাওই একটি দিন আমরা পান্তা খেয়ে ধনী হতাম ।বাবার অকালে পেকে যাওয়া সাদা চুলে মা হাত বোলাতেন আর বলতেন, আশীর্বাদ করো তোমার সন্তান দুটি যেন মানুষ হয় ।দিদির শোবক্স ভর্তি খুচরো পয়সায় একটি সস্তা গেঞ্জি কিনে বাবাকে দেওয়া মাত্রই তার চোখ টলটল করে উঠতো । তিনি বুকে হাত বোলাতেন আর অন্যমনস্ক চেয়ে কি যেন বিড়বিড় করে বলতেন…হয়তোবা মায়ের ফ্যাকাশে কালো ব্লাউজের দিকে তাকিয়ে থাকতেন ।

বাবার অঙ্গীকার গুলোতে লেপ্টে থাকা জমা যন্ত্রণাবাবার অভিসন্ধিহীন সরল জীবন বাবার পাড়হীন হেঁটে আসা নির্লোভ পাঠশালা আমাদের শিখিয়েছে কিভাবে সৎ বেঁচে থাকতে হয় ।বাবা তুমি মাথা তোলো…আমরাও সমতলে দাঁড়িয়ে থাকবো
এই শহর , এই মফস্বল, এই গ্রামের পথে পথে রাতের অ্যান্টেনার মতো ।সততা গিলে খাওয়া ওই লাল নীল বাড়ি গুলোর উপরে আমরা মিথ ভেবে কয়েন ছড়িয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো।মাথা তোলো বাবা ।

আমি তখন দ্বাদশ শ্রেণি,বাবা বলতেন, রোজ আযান দেওয়া মাত্রই ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসবে। আযান আগে শুনতাম কিন্তু বুঝতাম না। সেই থেকেই আযান শব্দটির উপর আমার সীমাহীন কৌতূহল। আযান কখন হয় , কোথায় হয়, কে দেয় ? আরো কত কি…একদিন নিজের অজান্তেই আবিষ্কার করে ফেললাম আযান মানে হচ্ছে আল্লাহ্‌কে উজাড় করে ডাকা ।মা আমাকে বেশ আস্কারা দিতেন । আমার চাওয়া পাওয়া , আবদার অভিযোগ মানেই মা । মা আমাকে খেলতে পাঠাতেন। খিদে পেলেই হাতে কচকচে দশ টাকার একটি নোট গুঁজে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন শর্ত কিন্তু একটাই , সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফেরা চাই ।সন্ধ্যার বিশেষত্ব এবার আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সন্ধ্যা মানে কি দিনের শেষ ? রাখাল গরুর ঘরে ফেরা? ফুরালো দিন, শঙ্খধ্বনি !!সেইদিন জানলাম সন্ধ্যা মানে মায়ের মুখে পুজোপাঠ , ক্লান্ত বাবার ঘরে ফেরা ।এবার পড়ে রইলো প্রিয় দুপুর ।বিন্দুর কাছে দুপুর ছিলো সবচেয়ে অর্থবহ । সারাদিন থেকে সে ওইটুকু সময় চুরি করে আমার জন্য নির্জন রাখতো । পাঠশালা থেকে ফেরার সময় পুকুরপাড়ের পুরনো মন্দিরের গায়ে দেওয়ালের ভাজে রোজ একটি করে চিরকুট । চিরকুটের প্রতিটি অক্ষরে মিশে থাকতো চেনা অভিমান , দাড়িতে দীর্ঘশ্বাস , কমায় আঁকা থাকতো শতাব্দীর কষ্ট ।

তবু ওই একটুখানি নির্জন রোদে চোখাচোখি ভুলিয়ে দিতো সমস্ত অভিমান । সেই অর্থে দুপুরই ছিলো আমাদের প্রিয় বেলা। এখন আমার কাছে ভোর মানেই প্রিয় আযান, সন্ধ্যা হল পুজোপাঠ । দুপুর মানেই বিন্দু, নির্জনতর পুকুরঘাট ।

 

আর এ