শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, পৌষ ৭ ১৪৩১

বাবাকে নিয়ে স্মৃতিকথা

জিনাত নাজিয়া

প্রকাশিত: ২০:৩৬, ৬ জুন ২০২২

বাবাকে নিয়ে স্মৃতিকথা

ছবি ইন্টারনেট

 
গোধুলির আলো তখনো মিলিয়ে যায়নি। লাল হলুদের মিশালে মনে হচ্ছে পৃথিবীও আজ গায়ে হলুদের সাজে সেজেছে। ডানা ঝাপটানো ক্লান্ত পাখিরা জোড়ায় জোড়ায় ফিরে যাচ্ছে ওদের ভালোবাসার নীড়ে। সাঁঝের এমন  মন ভোলানো রুপে  মুগ্ধতা আমায়
 বিষন্ন করে তুললো । হঠাৎ আমার নাম ধরে বাবার চিৎকার। কাছে গিয়ে দেখলাম, যদ্দুর  দূরে সম্ভব বা হাত শরীর থেকে সরিয়ে গাছের পাতা দিয়ে একটা কেরোসিনের বোতল উঁচিয়ে ধরে আমাকে বললেন," ধর,ধর, তাড়াতাড়ি এটা ধর, তোর তো রাত জেগে পড়তে হবে তাই নিয়ে এলাম। এটা রেখে জলদি আমাকে সাবান পানি দে। যেই গন্ধ। আল্লাহই জানে হাতের গন্ধ কতক্ষনে যায়।" বাবার অবস্থা দেখে আমার হাসি পেলো।

আমার সহজ সরল বাবা।কেরোসিনের গন্ধ একদম সইতে পারতেন না। তখন আমাদের বিদ্যুৎ ছিলো না। কলেজের একটা  ঝামেলায় আমাদের তিন বন্ধুর ইন্টার ইমিডিয়েট পরীক্ষাটা আটকে  ছিলো। বুঝতে পারছিলাম বছরটা এবার মিস হবে, কিছুই
 করার ছিলো না। কিন্তু হঠাৎ একদিন আমার এক বন্ধু এসে খবর দিলো যে,  ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে  আমাদের সবার ফাইনাল পরীক্ষা দেয়ার ব্যাবস্থা করা হয়েছে । সেদিন আনন্দে আমার চোখ ভিজে এলো। কিন্তু হিসেব করে দেখলাম পরীক্ষার আর মাত্র তিন মাস বাকি। দু' বছরের কোর্স তিন মাসে কিভাবে শেষ করবো। অসম্ভব। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। বাসার সবাই সাহস দিলো বিশেষ করে বাবা। মাথায় হাত দিয়ে বললেন," তুই  পারবি মা, সব সাব্জেক্টে পাশ মার্ক পাওয়ার মতো করে পড়বি, দেখবি  হয়ে যাবে। মনে সাহস রাখ। একদম ঘাবড়াবিনা। কেরোসিন না থাকলে আমাকে বলবি। " তাই, সেদিন মেয়ের জন্য বাবা তার সবচেয়ে অপছন্দের কেরোসিন আনতে গিয়ে সমস্যাটাকে সমস্যা মনে করেন নি। তাঁর এমন অপ্রিয় জিনিসটা ও নির্ধিধায় আমার জন্য হাতে তুলে নিয়েছিলেন । এই হচ্ছেন অপরিসীম ধৈর্যের অধিকারী  আমার বাবা। আমিও অবশ্য সেই পরীক্ষায় বাবাকে হতাশ করিনি।সফল ভাবে উৎরে গিয়েছিলাম সেই ভয়াবহ বেদনার সিঁড়িটা।

প্রচুর গান শোনার বাতিক ছিলো আমার। তখন " উত্তরন" নামে রাত ন'টায় বাংলাদেশ বেতারে একটা  প্রোগ্রাম হতো। সেখানে দর্শকদের অনুরোধের গান শোনাত। সেদিন ভাগ্যক্রমে  আমারই অনুরোধের গানটা ছিলো,  কুমার বিশ্বজিৎ এর, "তোরে পুতুলের মতো করে"...গানটা। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম।হঠাৎ বাবার রাশভারি  গলা," রেডিও বন্ধ কর,নামাজ পড়ব।"আমি তো পড়লাম মহা বিপদে । এই গান তো কিছুতেই মিস করা যাবে না। বিদ্যুৎ বিহীন এই গ্রামের বাড়িতে এতো  রাতে বাইরে যাওয়ার ও কোনো উপায় নাই। তাই  যদ্দুর সম্ভব সাউন্ড কমিয়ে রেডিওটা কানের পাশে ধরে প্রিয় গান শুনছিলাম। এতো কমানোর পরেও সেদিন বাবার কর্ন কুহরে কিভাবে যে গানের সুর প্রবেশ করেছিল, আমি আজও তা বুঝতে পারিনি।লাঠি নিয়ে তেড়ে এলেন।অগ্নিমূর্তি ধারণ করে লাগালেন দু'ঘা আমার উপর। যদিও আঘাত গুলো সব সহ্য  করেছে ভাইয়ার থেকে উপহার পাওয়া আমার  প্রিয় রেডিওটা। আহা! বেচারা, জানিনা এটা আবার চালু হবে কিনা। মা এসে বাবাকে সরিয়ে নিলেন।
 
বাবার উপর সেদিন ভীষণ রাগ হলো। মায়ের হাজারো অনুরোধে ও রাতে ভাত খাইনি। ঘুম থেকে উঠে শুনি বাবা ও রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। এই হচ্ছেন আমার বাবা। যার স্নেহ আর শাসনের নির্মেঘ আকাশে আমরা ছিলাম সাত সাতটি নক্ষত্র। কিছুদিন পরেই আমারবিয়ে হয়ে গেলো।  চলে আসব ঢাকায়। সব প্রস্তুতি শেষ। বাবাকে সালাম করতেই আমার মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরলেন। সব বিপদে এতো এতো সাহস যোগানো বাবাটা আমার সেদিন হু হু করে বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠলেন। এতো গুলো দিন বাবার সাথে কাটিয়েছি,অথচ বুঝতেই পারিনি সন্তানের জন্য বাবার এতো এতো ভালোবাসা জমে আছে। বুকের ভিতরটা ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল আমার । সবাই কাঁদছিল। ঐ মুহূর্তে  নিজেকে কিভাবে সামলেছি আজ আর মনে করতে চাইনা। চলে এলাম, পেছনে ফেলে এলাম বাবার সাথে হরেক রকমের  মন মাতানো শৈশব আর কৈশোরের  এলোমেলো  স্মৃতিগুলো। এখন সবচেয়ে যে ব্যাপারটা বেশি মিস করি, সেটা হলো  বাবার সাথে গাছের যত্ন নেয়া। এখন যখন নিজের বাসার গাছের যত্ন নেই, মনে হয় এই বুঝি বাবা এসে বলবেন- এই গাছটায় একটু সার বেশি দে তো মা। মাঝে মধ্যে এখনো সেই সব স্মৃতিগুলো আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় গভীর সাগরের অতল গহব্বরে।
 
বড় ভাইয়া আর আমি মিলে ঢাকায় সংসার শুরু করলাম। সব কিছু তেমন করে গোছানো ও হয়নি। সন্ধ্যার আঁধার না নামতেই অন্ধকার করে আকাশ ভেঙে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। টিনের চালে বৃষ্টির পাগল করা রিনিঝিনি শব্দ। সকাল আটটা ও বাজেনি তখন। বাইরের গেটে কেউ যেন  খুব জোরে কড়া নাড়ছে। বিরাট এক পোটলা হাতে একটা ছায়া মুর্তি  ঠকঠক করে কাঁপছিলো । আমি ভয়ে ভয়ে ওকে পাঠালাম।  ওমা!  এতো দেখি আমার বাবা। কিযে খুশি হয়েছি সেদিন  বাবাকে দেখে, বলে বোঝাতে পারবো না।
বাবাকে ফ্রেশ করে বসাতেই ভাইয়া এসে বললো," কি ব্যাপার বাবা,এই ঝুম বৃষ্টির ভিতর এতো ঝুঁকি নিয়ে আসলেন।" " তোর মায়ের কান্নাকাটি সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই তোদেরকে  দেখতে এলাম।" বাবার কন্ঠে যেন পরিতৃপ্তির ছায়া।
" ও এই অবস্থা। আজ এতো দিন আমি ঢাকায় আছি কই একদিন ও তো আসতে দেখলাম না, মেয়ে এক সপ্তাহ না আসতেই ঝড়বৃষ্টি মাথায়  করে  এসে হাজির।" ভাইয়ার কন্ঠে অভিমানী সুর।

বাবা ভাইয়ার কথার জবাব না দিয়ে মিটিমিটি হেসে মায়ের পাঠানো পোটলা পুটলি গুলো আমায় বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।  সন্তানের নতুন সংসারে বাবার প্রথম আগমন, সে এক অন্য রকম অনুভূতি। বলে বোঝানো যাবেনা।  আজও বাবার সেই হাসিমুখ, শাসনের বেড়াজালে আদরের হাতছানি,  মাঝে মধ্যেই বুকের মাঝে শিরশির  শব্দে হাহাকার করে উঠে।

আমাদের হাজারো বিপদে ঢাল হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাবাটাকে আজও খুঁজে ফিরি  হাজারো মুখের ভিড়ে।  ওপারে ভালো থাকুন বাবা। সন্তানের  জন্য একমাত্র ভরসার  ক্রেডিট কার্ড বাবার জন্য অফুরন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। এখন  কেউ যখন আমাকে খুব কষ্ট দেয় তখন আমি আমার বাবা-মা  কে খুউব...খুউব... মিস করি।অনন্তকাল ভালো থাকুক আমার বাবা- মা।