ছবি- সংগৃহীত
ছোটোগল্প জীবনের বিস্তৃত-বর্ণিত উপাখ্যান নয়, আঁটোসাঁটো রচনা। লেখকের ব্যক্তিত্বমণ্ডিত অনুভূতিই ছোটোগল্পের বীজ। সর্বাধুনিক সাহিত্যশিল্প এই ছোটোগল্পে থাকে জীবনের খণ্ডচিত্র। মানুষের বিস্ময়, আবেগ, অনুভূতি, স্বপ্ন-কল্পনা, জীবন প্রণালী, আচার-আচরণ, বিশ্বাস, সংগ্রাম, প্রেম-চেতনা, প্রকৃতি-চেতনা ও রহস্যানুভূতির অপরূপ মিশ্রণ আছে সায়র আলমগীরের ছোটোগল্পে। জীবনসত্য ঘটনার গ্রন্থণ নৈপুণ্য ও মায়াবী বুনন দেখে আমার উপলব্ধি তাঁর শিল্পমানস লক্ষ্যাভিমুখী এবং সপ্রতিভ। দৈর্ঘ্যে হ্রস্ব কাহিনি-কল্পে মাধুর্য ও সৌন্দর্য সুপরিস্ফূট। সমাজ-সমস্যা, আদর্শ-বৈষম্য, অসামঞ্জস্য, বিসংগতির পাশাপাশি সৌন্দর্যতন্ময়তা, ভাবাদর্শ, স্বপ্ন-কল্পনার সংমিশ্রণে যে গল্পসৌষ্ঠব নির্মিত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। গল্পহীন বর্ণনার মতো অপকৌশলের আশ্রয় নিলে তা কখনো ছোটোগল্প হবে না যতই তা ক্ষীণতনু হোক, হোক ঝটকায় শুরু ঝটকায় শেষ। ছোটোগল্পের প্রাণভ্রমরা গল্পই, ছোটোগল্পে গল্পের মাংস থাকতেই হবে। জীবনচিত্রের ঘটনাংশই গল্পরূপে প্রকাশ করেছেন তিনি ছোটোগল্পে। মানবচরিত্রের দহন-পীড়ন, ব্যথা-বেদনা, হাস্যরস তাঁর ছোটোগল্পের মূল উপজীব্য। জীবনের বিশিষ্ট খণ্ডাংশগুলোকে তিনি ছোটোগল্পে রূপায়িত করেছেন। প্রত্যেকটি ছোটোগল্পের ঘটনার ঘনঘটা আর বর্ণনার ছটা নান্দনিক। মন শিল্পদৃষ্টিসম্পন্ন হলেই তবে ছোটোগল্প লেখা সম্ভব। সৃজনশীল না হলে লিখে সৌন্দর্যসৃষ্টি ও আনন্দদান সম্ভব না। ছোটোগল্পগুলোর অন্তর্নিহিত ভাবময়তায় গল্পকারের যে চিন্তার ব্যাসার্ধ বিদ্যমান অন্তর্দর্শনে বুঝতে পারলে তা শিল্পভাষ্যে অত্যন্ত শৈল্পিক ও শিল্পগুণসম্পন্ন হবে। জীবনের সহজ-সরল যাপন, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনা, আনন্দ-উল্লাসঘন মুহূর্তগুলো অনন্য বর্ণনায় উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর ছোটোগল্পে। ছোটোগল্পের কাহিনি গতিময়ে রূপায়ণ, তীব্র গতিস্রোতে বহমান যার আঙ্গিক, বিষয় ও ঘটনা একমুখী যা কিনা একটি ঘটনার নাটকীয় ব্যঞ্জনাধর্মী, রসপূর্ণ সাহিত্যকর্ম। শেষাংশে ক্ষিপ্রতা, চমক, মোচড়, বাঁক, চরম উৎকণ্ঠা, নাটকীয়তা, বিচিত্র উপলব্ধি, আকর্ষণীয়তা রয়েছে। বিস্ময় ভরা তৃষ্ণা, আরও পড়ার তৃষ্ণা, চাবুক মারা সমাপান শেষাংশে থাকায় পাঠককে মোহিত করে রাখে। ❝এক মন অন্য মন❞ পাঠান্তে আমার অনুভূতি ব্যক্ত করছি।
কোনো একদিন (পেজ: ০৯-১৮):
সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে চাকরি করে অনিক। তার ক্যামেরা ম্যান রাকিব। অনিক একদিন রাতে ট্রেনে করে ঢাকাভিমুখী আসছিলো। গোটা ট্রেন ঘুরছিলো আর ঘুমন্ত যাত্রীদের দেখে দেখে বিভিন্ন ভাবনাজাল আঁকছিলো। হঠাৎই একজন ঘুমন্ত তরুণীকে দেখে অনিকের নব্বইয়ের দশকের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংঘটিত নির্বাচনের দিনের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। নির্বাচনের দিন এক তরুণের হতাহত হওয়ার ঘটনা সাংবাদিক অনিককে বলতে গিয়েছিলো তরুণীটি। কিন্তু যখন জানতে পারে সরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক অনিক, তখন তা বলা থেকে বিরত থাকে। পরবর্তীতে রাকিবের অগ্রসরতায় তরুণীটির থেকে তথ্যাদি নিয়ে অনিক রিপোর্ট প্রকাশ করে, আর তা টেলিভিশনে তরুণীটি দেখেও। পরেরদিন অনিক ও রাকিবকে চা খেতে দেখে তরুণীটি ও তার বান্ধবী তাদের সাথে চা খেতে বসে অনিকের প্রশংসা করে এবং ফোন নম্বর নেয়। কিন্তু দশ বছর কেটে গেলেও তরুণীটি অনিককে ফোন করেনি। আজকের ট্রেন যাত্রায় ঘুমন্ত এই তরুণীটিকে দেখে দশ বছরের আগে দেখা বাম রাজনৈতিক দলের কর্মী সেই প্রতিবাদিনী তরুণীটির কথা মনে বেজে উঠলো। স্মৃতি কাতরতা তাকে পেয়ে বসলো।
চেনা-অচেনা (পেজ:১৯-৩৪):
হাতিমারা স্কুল এন্ড কলেজের চাকরি ছেড়ে আদিয়ান ঢাকা গ্যাজেট পত্রিকায় চাকরি নেয়। কলেজটি ছেড়ে আসার দীর্ঘ বছর পর সেই কলেজের এক সময়ের সহকর্মী স্কুল শাখার গণিতের শিক্ষক সাহাবউদ্দিন আদিয়ানের সাথে যোগাযোগ করতে পারে এবং অনেক বোঝানোর পর পূর্বের কর্মস্থলে একটু ঘুরে যেতে বলে। পুরাতন কর্মস্থলের প্রতি সবারই অনেক মায়া কাজ করে, একারণে আদিয়ান সেই কলেজে যায় এবং কলেজটির অভূতপূর্ব পরিবর্তন দেখে মুগ্ধ হয়। ইতিহাসের শিক্ষক আসিফের সহয়তায় আদিয়ান সাহাবউদ্দিন স্যারের বাসায় যান। সাহাবউদ্দিন স্যার তাকে এতকাল পরে কেন ডেকেছেন জানতে চাইলে সাহাবউদ্দিন আদিয়ানকে একটি কবরস্থানে নিয়ে যায়। যেখানে শ্যামলীর কবরও আছে। দশম শ্রেণি পড়ুয়া শ্যামলী আদিয়ানকে ভালোবাসতো, ভালোবেসে পাগল হয়ে গিয়েছিলো, নিঃসঙ্গ হয়ে মারা যায়; যা জানতে পেরে আদিয়ান ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে।
নিয়তি (পেজ:৩৫-৪৬):
ওমায়ের ওম ও রেশমার মধ্যের প্রেমের গল্প নিয়তি। ক্রিয়েটিভ অফিসের জব ছেড়ে দিয়ে ওমায়ের নতুন অফিসে মহিলা বসের আন্ডারে জব পায়, যেখানে তার কাজ প্রপোজাল তৈরি। নতুন অফিসের নতুন কলিগ রাশেদ ও আবিরের সাথে অফিসের নিয়ম-কানুন সম্বন্ধে তার আলাপ হয়। বাইরে চা খাওয়ার সময় পুরাতন অফিসের কলিগ কৌশিকের সাথে দেখা হয় তার৷ 'সৃষ্টি' কারখানার সুপারভাইজার রেশমার ঠিকানা পায় কৌশিকের থেকে ওমায়ের, যে মেয়েটি তাকে ভালোবাসতো, কিন্তু রেশমা হিন্দু হওয়াতে ওমায়ের তা প্রত্যাখ্যান করে। পরবর্তীতে রেশমা রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়, মারা যাওয়ার আগে রেশমা অনিতা দির কাছে চিরকুট রেখে যায়। চিরকুটটি অনিতা দি ওমায়েরকে দেয়, তাতে লেখা ছিলো 'ভালোবাসি'। নিয়তির কারণে ওমায়ের ও রেশমার মিল হয়নি, এমনি এক রোম্যান্টিক ও ট্রাজেডি গল্প নিয়তি ছোটোগল্পটি।
শূন্যতা (পেজ:৪৭-৬০):
ইউনিভার্সিটিতে রাতিন পড়াশোনা করে। নির্দিষ্ট সময়ান্তে গ্রামের বাড়ি ফেরে, একদিন বাড়ি ফেরার পথে প্রচণ্ড বৃষ্টি হলে বাস খাদে পড়ে। ফলে সে গ্রামের নির্মাণাধীন রাস্তা দিয়ে নিজ গ্রামে ফিরছিলো। হঠাৎই এক মেয়ের দেখা পায় সে এবং তাকে তার ভালো লাগে। নিজের ফোন নম্বর দিলেও মেয়েটির রেসপন্স সে পায় না। ইউনিভার্সিটিতে ফিরলে মনমরা হয়ে থাকে, তার বন্ধু-বান্ধব সেনিন, শায়না ও রয়া তার মন খারাপের মানে পায় না। রাতিন অসময়ে গ্রামের সেই পথে ফেরে, কিন্তু সেই ঐশ্বরিক দ্যুতির মেয়েটির দেখা আর পায় না। ফলে তাকে এক প্রকার ভুলেই যায়। হঠাৎ একদিন সেতু আর রিয়ার সাথে দেখা হয় রাতিনের, যারা দিপার বান্ধবী। দিপাও যে রাতিনকে ভালোবাসতো তা রাতিন সেতু ও রিয়ার থেকে জানতে পারে। কিন্তু সমাজ বাস্তবতার নির্মমতায় ইভটিজিং আর বুলিঙের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে দিপা। জানতে পেরে রাতিনের ভেতর একরাশ শূন্যতা গ্রাস করে।
নূপুর (পেজ:৬১-৭৬):
দরিদ্র ঘরের ছেলে শাওন ইউনিভার্সিটিতে অনার্সে পড়ে আর গ্রুপ থিয়েটারে নাটক করে বেড়ায়। পাশাপাশি বরিশালের মেয়ে নূপুরের সাথে পত্রমিতালি করে। নূপুরের এক বোন ঢাকাতে থাকে, শাওন ঢাকাতে নূপুরের সেই বোনের সাথে দেখা করলে তার বোন প্রশ্ন করে তাদের মধ্যে শুধু পত্রমিতালি, নাকি প্রেমও আছে? শাওন প্রেমের বিষয়টি স্বীকার করলেও বিবাহতে রাজি হয়নি; কারণ সে ছিলো ছাত্র ও গরীব ঘরের সন্তান। এরপর আর পত্রমিতালি হয়নি তাদের মধ্যে, কিন্তু নূপুরের কথা মনে পড়লেই সে বরিশালের লঞ্চ ধরে বরিশালে যায় আর বরিশালের আলো-বাতাসে নূপুরের অস্তিত্ব খোঁজে। এবার বরিশাল যাওয়ার পথে লঞ্চে সেই বোনটির সাথে দেখা হলে সে জানতে পারে নূপুরের বিবাহ হয়ে গিয়েছে। হৃদয়টা ভেঙে-চুরে ছারখার হয়ে যায় শাওনের।
চিরকুট (পেজ:৭৭-৯৩):
অনেক বছর পর বুক সেলফটা নাড়তে গেলে কিছু বই পড়ে যায় এবং বইয়ের ভেতর থেকে একটি চিরকুট বের হয়ে আসে। অভিনুর সিনহা যার ডাকনাম অনন্ত, তার আজ অনেক কাল পরে মনে পড়ে কলেজে শিক্ষকতা করার সময় তার বাংলা পড়ানোর কৌশল ও সুদর্শনে মুগ্ধ হয়ে অফিস পিয়ন সালাম মারফত গিফট প্রেরণ করে তার এক ছাত্রী অচেনা পরিচয়ে। বাসায় ফিরে র্যাপিং খুলে অনন্ত দেখতে পায় তার প্রিয় ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদারের 'কালবেলা' উপন্যাস ও জীবনানন্দ দাশের 'বনলতা সেন' কাব্যগ্রন্থ। 'কালবেলা' উপন্যাসের পৃষ্ঠা উল্টাতেই একটি চিরকুট পায় সে। পরিচয়হীন এক অচেনা মুসলিম ছাত্রীর প্রেমময় চিরকুট যেখানে ছাত্রীটি স্যারের রূপে মুগ্ধের কথা উল্লেখ করে। অনন্ত পরবর্তী ক্লাসে উক্ত মেয়েটিকে চেনার চেষ্টা করে, কে তার দিকে উদাসীনভাবে চেয়ে থাকে দেখার চেষ্টা করে, কিন্তু কোনোভাবেই ছাত্রীটিকে আবিষ্কার করতে পারে না। অধ্যক্ষ আমির উদ্দিন স্যারের অবসরের পরপরই অনন্ত চাকরি থেকে অব্যাহতি নেয়। দীর্ঘকাল পর বই থেকে বের হয়ে পড়া চিরকুটটি দেখে অচেনা মেয়েটির কথা ভাবতে থাকে অনন্ত। স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে শীতকালীন অবকাশে পুরাতন কর্মস্থল আরও একবার ঘুরতে আসে। তখন অচেনা মেয়েটিকে পাতাবাহার গাছের নিচে সন্দেহজনকভাবে আবিষ্কার করেছিলো, কিন্তু অধ্যক্ষ স্যারের সাথে কথা বলার ব্যস্ততায় সাক্ষাৎ করতে পারেনি। আজ সেই পাতাবাহার গাছের নিচে এসে অচেনা সেই মেয়েটির অস্তিত্বের গন্ধ পায় সে।
অর্ঘ (পেজ:৯৪-১১২):
গরীব ঘরের ছেলে নীলাভ। নীলাভ মায়ের দেওয়া নাম। পরিবারে আছে অবসরে যাওয়া বাবা, আছে মা ও ভাই-বোন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে আর্থিক সংকটে পড়ে সে, পড়ে আবাসন সংকটে। গ্রামের এক পরিচিত ভাইয়ের রেফারেন্সে কিছুদিন এক বড়ো ভাইয়ের সাথে মেসে থাকতে পারে। পরে বান্ধবী রয়ার সহয়তায় ও বড়ো ভাই সাজিদের ভূমিকায় সূর্যসেন হলের গণরুমে ঠাঁই পায়। কিন্তু ক্লাস বাদ দিয়ে মিছিল-মিটিং এ জেতে হতো। তারপর উপরের ক্লাসে উঠলে হলে সিট পায় নীলাভ, তখন রাজনৈতিক চাপে আর পড়তে হয় না। এরপর বান্ধবী আয়রার প্রেমনির্ভর ইশারায় প্রেমে পড়ে যায় নীলাভ। বন্ধু-বান্ধব বিনা, নিনি, সানিম, সাফাত, সাব্বির, রয়া এরা নীলাভ-আয়রার প্রেম করা দেখে খুঁনশুটি করে। ছাত্র হিসেবে নীলাভ ভালো, আর তাই মাহবুবা আপা তাকে প্রেম করতে নিষেধ করে। হঠাৎ একদিন আয়রা এসে বলে তার আংটি বদল হয়ে গিয়েছে, এমনকি কাবিননামাও হয়েছে। আয়রার এমন দ্বিচারিতায় নীলাভ মুষড়ে যায়। দরিদ্র মানুষদের জন্য প্রেম বিলাসিতা তা অর্ঘ গল্পে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
একটা বিকেল (পেজ:১১৩-১২০):
দিপক যার ডাকনাম দিপু, পেশা শিক্ষকতা। ক্লাসের ডেকোরামে গুরুত্ব দিয়ে যত্নসহকারে স্নাতকের ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ায়। স্যারের ক্লাসের দিপা নামের মেয়েটি খুব জেদি, স্যারকে পছন্দ করে, স্যারের ক্লাসে উদাসীন হয়ে থাকে, কিছুটা দুরন্তপনাও করে। একদিন কলেজ ছুটি হলে বৃষ্টি আসায় যাত্রী ছাউনির নিচে আশ্রয় নেয় দিপু স্যার, সেখানে দিপা এসে উঠে তার বান্ধবী মানহাকে নিয়ে। এক পর্যায়ে স্যারকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে চায় দিপা। স্যারের কঠোর চিত্তের কারণে দিপার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ওদিন বৃষ্টির কারণে দিপু স্যারের জ্বর আসে, যার কারণে বেশ কদিন কলেজে আসতে পারেনি। জ্বরের ঘোরে দিপাকে স্বপ্নে দেখে সে, দেখে প্রিন্সিপাল স্যারের কঠোরতাও। জ্বর সারলে কলেজে আসলে মানহা মারফত জানতে পারে দিপা চলে গিয়েছে বাবার সাথে পুলিশ বাবার বদলির কারণে। যাওয়ার আগে মানহার কাছে একটি চিরকুট রেখে যায় দিপা, যাতে স্যারের সাথে বৃষ্টিতে ভেজার আকুলতা প্রকাশ করেছে দিপা, একটা বিকেল বুকে মাথা রেখে কান্না করার ইচ্ছাও পোষণ করেছে। দিপার ঠিকানাটা পাওয়ার আকুলতা দেখা যায় দিপু স্যারের ভেতর।
সৌন্দর্যতন্ময়তা ❝এক মন অন্য মন❞ ছোটোগল্পটির-
❝কোনো একদিন❞ ছোটোগল্পে ট্রেনের ভেতরের মানুষের জীবনচিত্রের অপূর্ব বর্ণনা রয়েছে। ট্রেনে রাতে ঘুমকাতর মানুষের বর্ণনা অনিন্দ্য। রয়েছে সুরমা নদীর নান্দনিক বর্ণনা, রয়েছে বাম রাজনীতি করা কিছু তরুণীর দৃঢ়তার কথা। মানুষের জীবন, জীবনের খেলা, জীবনযুদ্ধ বিষয়াদির অপূর্ব সমন্বয় আছে ছোটোগল্পটিতে।
❝চেনা-অচেনা❞ ছোটোগল্পটিতে আধা-মফস্বল শহরের নান্দনিক বর্ণনা আছে, পথের দু'ধারের অপূর্ব বর্ণনা মোহিত করে, করে আবেগতাড়িত। ছোটোবেলার বর্ণনা; হৈ-হুল্লোড় ছোটোবেলাকে মনে করিয়ে দেয়, আছে বেসরকারি কলেজের ভালো-মন্দ বর্ণনা, আছে দ্রুত নগরায়নের প্রভাব নিয়ে দুশ্চিন্তা।
❝নিয়তি❞ ছোটোগল্পটিতে আছে কার্তিক মাসের অপূর্ব বর্ণনা যা আবহমান গ্রাম বাংলার কথা মনে করিয়ে দেয়, রেশমাকে ঘিরে ওমায়ের ওমের অনুভূতির অপূর্ব বর্ণনা আছে, মানবিক ও স্পর্শিক অনুভূতির অপূর্ব বর্ণনা পাঠককে আন্দোলিত করে।
❝শূন্যতা❞ ছোটোগল্পটিতে প্রকৃতির অপূর্ব বর্ণনা আছে, আছে বৃষ্টির বর্ণনা, শহরের ইট-কাঠ-কংক্রিটের জীবন থেকে শুরু করে গ্রামের কর্দমাক্ত রাস্তার বর্ণনাও লক্ষ্য করা যায়, আছে কর্দমাক্ত শিশুদের আনন্দে লুটোপুটির কথা। আশ্বিন মাসের বর্ণনা আছে, আছে গ্রামীণ বাংলার চিত্র।
❝নূপুর❞ ছোটোগল্পটিতে পালতোলা নৌকা, গুণটানা নৌকা, দাড়টানা নৌকার পাশাপাশি মালবাহী নৌকার বর্ণনা পাওয়া যায়, নদীপাড়ের অপূর্ব চিত্র রয়েছে, রয়েছে শৈশবের স্মৃতির বর্ণনা, আছে জলে ডোবাডুবির মতো চিত্রও, আছে ঐতিহ্যের বর্ণনা, সেই সাথে হেমন্তের বর্ণনাও দেখা যায়। পত্রমিতালী, গ্রুপ থিয়েটার বিষয়গুলোও অপূর্ব সুন্দর বর্ণনায় তিনি সামনে এনেছেন।
❝টিরকুট❞ ছোটোগল্পটিতে বই সংগ্রহের মতো দারুণ একটি চিত্র পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষকতা পেশার নানা দিক রয়েছে বর্ণনায়, আছে হেমন্তের বর্ণনা, আছে শিশিরভেজা সকালের চিত্র, আছে রবীন্দ্র সংগীতের প্রতি দুর্বলতার প্রকাশ। আছে শহরের যান্ত্রিকতার সাথে গ্রাম ও প্রকৃতির তুলনা, আছে পুরাতন কর্মস্থলে ফিরে স্মৃতি রোমন্থনের মতো বিষয়।
❝অর্ঘ❞ ছোটোগল্পটিতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সংগ্রাম, সংকট, শিকার হওয়ার মতো বিষয় রয়েছে, রয়েছে মধ্যবিত্ত ঘরের এক ছেলের জীবনযুদ্ধ, আছে রাজনৈতিক ডামাডোলের চিত্র। আছে গণরুমের চিত্র, বিভাগের বন্ধুদের হৃদয়ালুতা, বড়ো ভাইয়ের সাহায্য, প্রেমের নান্দনিকতা ও বিচ্ছেদের কষ্টও ফুটে উঠেছে।
❝একটা বিকেল❞ ছোটোগল্পে আছে মফস্বলের কলেজের চিত্র, আছে বৃষ্টিমুখর দিনের চিত্র, আছে লালমাটির পথের চিত্র।
সমালোচনা ❝এক মন অন্য মন❞ ছোটোগল্পটির-
❝কোনো একদিন❞ ছোটোগল্পে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম নির্বাচনের আবহ আছে, এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা থাকলে জানতে সুবিধা হতো। বাম রাজনীতি করা এক তিলক পরা মেয়েকে অনিক নিজের ফোন নম্বর দিয়ে দশ বছর তার কাছ থেকে ফোনকল ব্যাক পাওয়ার মতো গল্পের বিষয়টি সাধারণ পাঠকের মনোগভীরকে স্পর্শ করে উঠতে পারে না।
❝চেনা-অচেনা❞ ছোটোগল্পে হাতিমারা স্কুল এন্ড কলেজের প্রাক্তন কলিগের ডাকে সাড়া দিয়ে পুরাতন কর্মস্থলে ফিরে জানতে পারে যার প্রতি আদিয়ান দুর্বল ছিলো সেই ছাত্রী শ্যামলী আদিয়ানের কর্মস্থল ত্যাগের পর নিঃসঙ্গ হয়ে মারা যায়। আদিয়ানের সাথে প্রেম না হয়েও আদিয়ানের শূন্যতায় শ্যামলী মারা যায় বিষয়টি প্রেমময়তার গভীরকে স্পর্শ করতে পারে না।
❝নিয়তি❞ ছোটোগল্পে পুরাতন অফিস থেকে নতুন অফিসে জবের ব্যাপারটি ❝চেনা-অচেনা❞ গল্পের মতোই একই প্লটের। পুরাতন অফিসের কলিগ কৌশিকের মাধ্যমে ওমায়ের ওম রেশমার মৃত্যু খবর জানতে পারে। রেশমা হিন্দু হওয়ায় ওমের প্রেমাহ্বানকে গ্রহণ করে না। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ওম ও রেশমার মধ্যে আলাপ হয় না; যদিও একটু আলাপ হয় তা ওমের নস্টালজিয়া ভাবনায়। অথচ অন্যান্য অপ্রধান চরিত্রের সাথে কেন্দ্রীয় চরিত্রের বেশি বেশি কথোপকথন পাঠককে আহত করে।
❝শূন্যতা❞ ছোটোগল্পেও অপ্রধান চরিত্রের আধিক্য বেশি, অপ্রধান চরিত্রের আলাপচারিতা বেশি। কেন্দ্রীয় চরিত্র রাতিন ও দিপার মাত্র একদিন পথে দেখা হয়। কেন্দ্রীয় চরিত্র দ্বয়ের যদি একদিন পথে দেখা হয় আর অন্যান্য চরিত্রের সাথে রাতিনের প্রারম্ভ থেকে শেষাংশ পর্যন্ত কথাবার্তা হতেই থাকে, তবে তা পাঠককে পাঠে ধারাবাহিকতায় থাকতে দেয় না।
❝নূপুর❞ ছোটোগল্পে পত্রমিতালীর মাধ্যমে নূপুর ও শাওনের মধ্যে প্রেম হলেও দারিদ্র্যের কারণে গ্রহণে শাওনের দ্বিধা। ফলশ্রুতিতে, নূপুরের অন্যত্র বিবাহ পাঠককে মর্মাহত করে ঠিকই, কিন্তু গল্পের এই বিষয়টি পাঠক নিত্য দেখে অভ্যস্থ। পাঠক সর্বদা নতুনত্ব চায়, গল্প শেষের আগেই গল্পের কাহিনি বুঝতে চায় না।
❝চিরকুট❞ ছোটোগল্পে ❝চেনা-অচেনা❞ ছোটোগল্পটির মতোই স্যারের প্রতি ছাত্রীর ভালোবাসা দেখতে পাওয়া যায়। সুদর্শন স্যারেদের প্রতি ছাত্রীদের দৃষ্টিশোভনতা থাকে বৈকি, কিন্তু তা গল্পে এভাবে প্রকাশ পাঠক সহজে নিতে পারে না।
❝অর্ঘ❞ ছোটোগল্পে গরীব ঘরের ছেলে নীলাভের সাথে আয়রার প্রেম পাঠককে আন্দোলিত করে, কিন্তু আয়রার নীলাভকে ছেড়ে যাওয়া পাঠক নিতে পারে না। হঠাৎ করে আয়রা নীলাভকে ছেড়ে গেলো কেন তার প্রকাশ নেই, পাঠক এ কারণে রুষ্ট হতেই পারে গল্পকারের প্রতি।
❝একটা বিকেল❞ ছোটোগল্পটিতেও ❝চেনা-অচেনা❞ ও ❝চিরকুট❞ গল্পের মতো স্যারের প্রতি ছাত্রীর প্রেম দেখা যায়। একটি গল্পের বইয়ে এমন বিষয়ে একাধিক গল্প পাঠককে তাড়িত করতে পারে না।
গ্রন্থটির আটটি গল্পেই নায়কের সাথে নায়িকার মিল না হতে পারা পাঠককে আশান্বিত করতে পারে না। প্রতিটি গল্পেই নায়কের প্রেমের প্রতি আগ্রহ আর নায়িকাদের ছেড়ে যাওয়া, ক্ষেত্র বিশেষে নিরাসক্ততা একই রকম বোধ হয়, পাঠক বৈচিত্র্য চায়। আটটি গল্পই প্রেমের, কিন্তু বিয়োগাত্মক; যেখানে নায়ক এবং নায়িকার মধ্যে বিশেষ কোনো আলাপ হতে দেখা যায় না। এমনকি বেশিরভাগ গল্পেই নায়কের সাথে নায়িকার দেখাও হতে দেখা যায় না, যা আশ্চর্যজনক। প্রতিটি গল্পে অপ্রধান চরিত্রের সাথে নায়কের আলাপের আধিক্য বিচলিত করে পাঠককে। তেমনি প্রধান চরিত্রদ্বয়ের মধ্যে কথোপকথন প্রায় সব গল্পেই নেই, যা পাঠককে মুগ্ধ করে তুলতে পারে না।