শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, পৌষ ৭ ১৪৩১

ছোটোগল্পগ্রন্থ ❝অগ্রবর্তিনী❞: জীবনের জলছবি,বাস্তবতার সংমিশেল

সুভাষ চন্দ্র দাস

প্রকাশিত: ২০:৩৩, ১ মার্চ ২০২৪

ছোটোগল্পগ্রন্থ ❝অগ্রবর্তিনী❞: জীবনের জলছবি,বাস্তবতার সংমিশেল

ছোটোগল্পগ্রন্থ ❝অগ্রবর্তিনী❞

সাহিত্যের অন্যতম সংরূপ ছোটোগল্প। জীবনের খণ্ড খণ্ড মুহূর্তগুলোকে গল্পকারগণ শিল্পরূপ দিতে ব্যপ্ত হলেও বোদ্ধাদের তীর্যক চোখের তরবারি দীপ্তিতে শিল্পস্বীকৃতি পেতে বাধা পায়। তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণদৃষ্টিতে গল্পের ভাব-সুষমা, আঙ্গিক-প্রাঙ্গিক, গঠনশৈলী, পরিবেশনভঙ্গিতে ত্রুটি দৃশ্যত হলেও সৌমেন দেবনাথের গল্পগুলি পাঠান্তে মনে হয়েছে বর্ণনা নান্দনিক, শিল্পশর্তেও উত্তীর্ণ। দৈর্ঘ্যে হ্রস্ব কাহিনি-কল্পে মাধুর্য ও সৌন্দর্য সুপরিস্ফুট। সমাজ-সমস্যা, আদর্শ-বৈষম্য, অসামঞ্জস্য, বিসংগতির পাশাপাশি সৌন্দর্যতন্ময়তা, ভাবাদর্শ, স্বপ্ন-কল্পনার সংমিশ্রণে যে গল্পসৌষ্ঠব নির্মিত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। মহাকালের ঘূর্ণাবর্তে ব্যক্তিসত্তা হারালেও সৃষ্টিশীল কর্ম মূর্ত-বিমূর্ত পাতায় বেঁচে থাকে। যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার কপোতাক্ষ নদের পাড়ে জন্ম সৌমেন দেবনাথের গল্পের ভেতরের যে জীবন বীক্ষণ-পর্যবেক্ষণ, চারিত্রিক লীলার বিকার-বিকাশ, রস-সৌন্দর্য, যুগ-চিত্ত চৈতন্য উন্মোচিত তা বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় প্রাসঙ্গিক যা কালোত্তীর্ণ হতেও পারে। সৃষ্টিশীল কর্ম শিল্পমানে অনুত্তীর্ণ হলেও সমালোচনার পরিবর্তে সাধুবাদ জানানো যুক্তিযুক্ত।

সৌমেন দেবনাথের ❝অগ্রবর্তিনী❞ গল্পগ্রন্থটি পাঠান্তে আমার নিজস্ব উপলব্ধি তুলে ধরছি:

অনালোকের পথে (পেজ-০৯) ছোটোগল্পে আতিকুল চরিত্রের মধ্য দিয়ে গল্পকার সমাজের এমন এক বিষয় অবতারণা করেছেন যেখানে সমাজের মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করলে সমাজের চোখে কীভাবে শত্রু হয়ে যেতে হয় তার দৃশ্য স্পষ্ট। আত্মীয়-স্বজন, জ্ঞাতি-গোষ্ঠী পক্ষ থেকে সময়ের বদলে প্রতিপক্ষ হয়ে উঠার বিষয়ও রয়েছে, রয়েছে সমাজের জন্য ভালো কাজ করার কারণে নিজ স্ত্রীর রূপ পরিবর্তনের বিষয়টিও।

শ্রেয়াঙ্কা (পেজ-১৬) ছোটোগল্পটি একটি প্রেমনির্ভর গল্প। শ্রেয়াঙ্কা এবং ঐষিকের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন, সম্পর্কের টানাপোড়েন, সম্পর্কে গুরুত্বহীনতা এলে তার পরিণতি অত্যন্ত সুন্দরভাবে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। অন্য মেয়েদের ভালোবাসার প্রতি নিবেদিত প্রাণ আর গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র শ্রেয়াঙ্কার ভালোবাসার মানুষের প্রতি আস্থাহীনতার গাল্পিক রূপ শ্রেয়াঙ্কা ছোটোগল্পটি।

বেকারত্বের নিদারুণ দৃশ্য ফুটে উঠেছে পরাহত জীবন (পেজ-২৫) ছোটোগল্পে। মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও চাকরি না পাওয়ায় একজন মানুষের জীবনযুদ্ধে নিষ্পেষিত হওয়ার গল্প পরাহত জীবন। বেকার মানুষের সংসারে প্রবেশে বাধা এবং বিবেক জলাঞ্জলি দিয়ে প্রবেশ করলেও কতই যে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। অম্বিকার সাথে লেখকের মনোদ্বান্দ্বিক বিষয়াদি এ গল্পের প্রাণ।

অনুপম আর প্রাপ্তির সাংসারিক জীবনে নানা প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি নিয়ে দীর্ঘায়ুর অভিমান (পেজ-৩২) গল্পের কাহিনি এগিয়ে গিয়েছে। প্রেমময় সম্পর্কের পাশাপাশি সাংসারিক জীবনে বিষাদময় পরিস্থিতিও গল্পে এসেছে। পরস্পরের প্রতি আস্থা, কিংবা আস্থাহীনতার মতো বিষয়গুলো গল্পে দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। অতিরিক্ত ভালোবাসার মানুষের সাথে অতিরিক্ত অভিমানও হয়, তাই-ই এই গল্পে ফুটে উঠেছে।

কালারিজম নিয়ে গল্প কালো গোলাপ (পেজ-৪৬)। বর্ণবাদ নিয়ে লেখা কালো গোলাপ গল্পে কালো মানুষের সামাজিক অবস্থান, সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে। কল্যাণী কালো হওয়ার কারণে সমাজে কতভাবে হেয় হয়, পাশাপাশি ফাল্গুনী সুশ্রী হওয়ার কারণে কত বেশি সমাজে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে তা এই গল্পের মাধ্যমে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক।

সুতর্ণা আর তুষারের মধ্যের প্রেমময়তার গল্প অগ্রবর্তিনী (পেজ-৫৩)। মেধাবী তুষারের মেধাদীপ্ততার কারণে সুতর্ণা তুষারের সাথে সার্বক্ষণিক থাকে। কিন্তু তুষার তার মেধার স্বাক্ষর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রাখতে পারে না। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মেধা তেমন না থাকা সত্ত্বেও মেধার স্বাক্ষর রাখে সুতর্ণা। একারণে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে পড়ে যায় তুষার। চাকরিক্ষেত্রেও সুতর্ণা এগিয়ে যায়, তুষার হেরে যায়; মেধাবী মানুষের হেরে যাওয়া, এবং তুলনামূলক কম মেধাবীদের অগ্রসর হওয়া এবং কম মেধাবী সুতর্ণা তুষারের জন্য নিজেকে লুকিয়ে রেখে তুষারকে উপরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা দেখা যায় এই গল্পে।

শামীমের কাছে আব্বাস স্ত্রী রজনী সম্বন্ধে সবসময় ভালো ভালো কথা বলে। কিন্তু শামীম তার সংসারে স্ত্রী দ্বারা নির্যাতিত। এই কারণে শামীম আব্বাসের মুখের কথাতে বিশ্বাস করতে পারে না। গল্পে রজনী আব্বাসকে সংসারে অনেক চাপে রাখে, কিন্তু তা সে মানুষের সাথে বলে না, এই বিষয়টি লুকোচুরি খেলা (পেজ-৬০) গল্পের মূল বিষয়।

স্বপ্নীল আর অনুমেঘার মধ্যের অন্তরতম সম্পর্কের গল্প অনুমেঘার মন (পেজ-৬৬)। দুইজনের মধ্যের সুন্দর অনুভূতি আর আবেগের গল্প এটি যেখানে অনুমেঘা প্রচণ্ড ভালোবাসে স্বপ্নীলকে। কিন্তু স্বপ্নীলের অতীত সম্পর্কের কথা জেনে যাওয়ায় স্বামীর প্রতি অশ্রদ্ধা জন্মে অনুমেঘার। প্রচণ্ড ভালেবাসায় মানুষের খারাপ অতীত জেনে যাওয়ার কারণে প্রচণ্ড ঘৃণা জাগ্রত হয় অনুমেঘার মনে যা এই গল্পের মূল কাহিনি।

সৈকত এক্সপ্লোরার ট্রাভেল (পেজ-৭৫) ফেসবুক পেজের মাধ্যমে জানতে পারে সাশ্রয়ী মূল্যে দেশের ঐতিহ্যবাহী স্থান ভ্রমণ করা যায়। এই কথা সে তার পাঁচ বন্ধু রণৌত, আব্বাস, রিয়েল, কাদের ও শৌণককে জানালে তারা সবাই ভ্রমণে যেতে রাজি হয় এবং ভ্রমণে যায়। ভ্রমণে যাওয়ার সময় বাসের মধ্যের এক বিশ্রী অভিজ্ঞতার গল্প এক্সপ্লোরার ট্রাভেল ছোটোগল্পে ফুটে উঠেছে।

মল্লিকা আর ফল্লুরা দুই বোনের বিবাহ হয় দুই ভাই আদিল আর আশিকের সাথে। আদিল ও মল্লিকার ছেলে আমির দুষ্টু প্রকৃতির, অন্যদিকে আশিক ও ফল্লুরার ছেলে আবির শান্ত প্রকৃতির। দুষ্টু আর শান্ত প্রকৃতির দুই ভাইয়ের মধ্যের দ্বন্দ্বই উন্নাসিকের উৎপীড়ন (পেজ-৮২) গল্পের উপজীব্য যেখানে আমির প্রচণ্ড উন্নাসিক প্রকৃতির।

সাব্বির হাসি-খুশি প্রাণখোলা আর প্রাণবন্ত মানুষ। সকল পরিস্থিতিতেই সে হাস্যোজ্জ্বল থাকে। সাব্বিরের এই হাসি রুপনার প্রথম দিকে ভালো লাগতো। কিন্তু সাব্বিরের সংসারের বাইরের মানুষের সাথেও এমন হাসি-খুশি ব্যবহার করার কারণে রুপনার ভেতর দাহ্য হতে থাকে। সাব্বিরের হাসির কারণে রুপনার মনের ভেতরের যন্ত্রণা বৃদ্ধির মতো মনস্তাত্ত্বিক বিষয়াদি সাব্বিরের হাসি ও রুপনার মনোদহন (পেজ-৯০) গল্পের উপজীব্য।

নিনন বিবাহের উদ্দেশ্যে রুহিনীকে দেখতে একটি রেস্টুরেন্টে দেখা করে। রেস্টুরেন্টে দুইজনের মধ্যের আড়াই ঘণ্টার মতো আলাপ হয়। পরস্পর পরস্পরের জন্য চাওয়া-পাওয়া, পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে আলাপ হয়। কিন্তু পরস্পর পরস্পরের কাছে চাওয়ার মাত্রা বেশি থাকে, কোনো পছন্দের বিষয় ত্যাগের সদিচ্ছা কারও না থাকায় তাদের দুইজনের মধ্যের আড়াই ঘণ্টার আলাপ (পেজ-৯৮) বৃথা যায়।

কাজল, আরেফিন ও অমির বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন প্রিয় মানুষের পছন্দ (পেজ-৯৫) গল্পে ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পকার। কাজল রিতিমাকে প্রচণ্ড পছন্দ করতো। কিন্তু রিতিমার চাহিদার কাছে কাজল হেরে যায়। পরবর্তীতে আরেফিন ও অমি দুইজনই রিতিমাকে বিবাহের উদ্দেশ্যে তার বাসায় পর্যায়ক্রমে দেখতে যায়, কিন্তু রিতিমার পছন্দের কাছে তারাও হার মানে। অবশেষে রিতিমা কাকে বিবাহ করেছিলো সেই বিষয়টিই প্রিয় মানুষের পছন্দ গল্পের মূল কাহিনি।

কৌশিক মোনালিসাকে বিবাহ করতে চেয়েছিলো। কিন্তু মোনালিসার বান্ধবী নিবেদিতা কৌশিক কালো বলে অপছন্দ করতে প্রভাবিত করে। মোনালিসা কৌশিককে তাই বিবাহ করতে চায় না। কিন্তু কৌশিক ছিলো প্রতিষ্ঠিত ছেলে, নিবেদিতায় তাই তাকে বিবাহ করে বাবা-মায়ের কথা শুনে। বিষয়টি জেনে মোনালিসা হাসি দেয়, এমনই একটি সুন্দর কাহিনি আছে মোনালিসা হাসি (পেজ-১১৩) গল্পে।

আমির আর সোহার মধ্যকার প্রেমের গল্প মুদ্রার উত্তর-দক্ষিণ (পেজ-১২০), যেখানে সোহা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলে আমিরের সাথে দূরত্ব বাড়ে। সোহা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও আমির মনস্তাত্ত্বিকভাবে হেরে যায়, কারণ সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি। আর একারণে তাদের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যায় ও আমির নিজেকে লুকিয়ে নেয়; এমনই অম্লমধুর সম্পর্কের গল্প মুদ্রার উত্তর-দক্ষিণ।

ছোটোগল্প হিসেবে ❝অগ্রবর্তিনী❞ ছোটোগল্পগ্রন্থটি কতবেশি সফল বা বিফল সেটি সময় বলবে। তবে ছোটোগল্পের ধরন-ধারণ বিশ্লেষণ করে যতটুকু উপলব্ধি করতে পারি তার আলোকে বলা চলে ❝অগ্রবর্তিনী❞ গল্পগ্রন্থের প্রতিটি গল্পেই গল্প আছে। পড়লে সময় কেটে যায় সহসায়, টানটান কাহিনিতে একঘেয়েমি আসে না। পাঠক হিসেবে ❝অগ্রবর্তিনী❞ গল্পগ্রন্থটির সফলতা কামনা করছি এবং গল্পকারের মনের মধ্যের গল্পসাহিত্যের সত্তা চারাটি বৃক্ষ রূপ নিয়ে পত্র-পল্লবে সুশোভিত হয়ে ফুলে-ফলে মঞ্জুরিত-বিকশিত হোক এই প্রত্যাশা থাকলো।