ফুটবল ইতিহাসের সেরা তারকা পেলে
১৯৫৮ বিশ্বকাপ ফাইনালের ফুটেজ দেখা হয়নি। দেখা হয়ে ওঠেনি ১৯৭০ বিশ্বকাপ ফাইনালে ইতালিকে নিয়ে ছেলেখেলা করার দৃশ্যগুলো। কিন্তু একটি নাম খুব ছোটবেলা থেকেই মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল—এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো। ফুটবল কিংবদন্তি পেলের আসল নাম যে এটি, তা ক্লাস ফাইভেই জেনে গিয়েছিল বাংলাদেশের একটি প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা।
তিনি ফুটবল ইতিহাসের সেরা তারকা। কে না জানেন তাঁর নাম। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, কে নয়! যে ফুটবলের কিছুই বোঝেন না, সে-ও তাঁর নামটা জানেন। ছবি দেখলে বলে দিতে পারেন, ওই মানুষটা কী করতেন এক সময়। ফুটবলের সঙ্গে তাঁর নামটিই যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। তিনি ছাড়া ফুটবলের ইতিহাস অসম্পূর্ণ।
পেলের জন্ম ১৯৪০ সালের অক্টোবরে। তাঁর মা–বাবা ছিলেন বিদ্যুতের আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসনের খুব ভক্ত। সেটি কৃতজ্ঞতাবশতই। ১৯৩১ সালে বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন যখন মারা যান, তাঁর কিছুদিন আগেই সাও পাওলোতে পেলেরা যে এলাকায় থাকতেন, সেটি বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়েছে। তাই ১৯৪০ সালে ছেলে হলে তাঁরা তাঁর নাম রাখেন ‘এডসন’, ঠিক ‘এডিসন’ নয়। তবে নামটি প্রিয় বিজ্ঞানীর নাম অনুপ্রাণিতই।
একদিন মানুষের মুখে মুখে ফিরবে বলেই কি অত বড় নামটা এমন ছোট্ট আর সহজ হয়ে গিয়েছিল! হয়ে গিয়েছিল ঘটনাচক্রেই। বিখ্যাত আবিষ্কারক টমাস এডিসনের নামে মা–বাবা নাম রেখেছিলেন এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো। সেটাই হয়ে গেল পেলে। আসলে ছিল বিলে। ছোটদের খেলায় দারুণ গোলকিপিং করায় বন্ধুরা সে সময় ব্রাজিলে বিখ্যাত এক গোলকিপার ‘বিলে’র নামে ডাকা শুরু করলেন এডসনকে। মূলত বন্ধুকে খ্যাপাতেই। মুখে মুখে সেই বিলে হয়ে গেল পেলে।
খেলোয়াড়ি জীবনজুড়েই মানুষকে এমন বিস্ময়ের অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন পেলে। যত দিন খেলেছেন, দর্শকমনে আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়াটাকেই মনে করেছেন কর্তব্য। ফুটবল তো তাঁর কাছে ছিল আনন্দের সবচেয়ে নিষ্কলুষ এক বাহন—দ্য বিউটিফুল গেম। ‘জোগো বনিতো’ শব্দযুগল এমন বিখ্যাতও তো তাঁরই জন্য। কথাটা প্রথম ব্যবহারও করেছেন পেলেই। তাৎক্ষণিক আনন্দ দেওয়াই শুধু নয়, খেলাটিতে তাঁর প্রভাব আরও সুদূরপ্রসারী। পেলে না এলে ফুটবল এত জনপ্রিয়তা পেয়ে এমন গণমানুষের খেলা হয়ে উঠতে পারত কি না, সন্দেহ হয়। ফুটবলকে আনন্দের বাহন করে তোলার সেই কাজও করেছেন চরম অবক্ষয়ের এক যুগে। ষাটের দশকে ফুটবল মাঠে যখন নির্বিচার মারধরের চর্চা, পেছন থেকে ট্যাকল করা আইনসিদ্ধ, সেই সময়ে ফুল ফুটিয়ে গেছেন পেলে। এখনকার মতো সুরক্ষা পেলে না জানি আরও কত কী করতেন!
ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার পেলে আর নেই। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। আলবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মারা গেছেন তিনি।ব্রাজিলের স্থানীয় সময় বিকেল ৩টা ২৭ মিনিটে হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। পেলের মেয়ে নাসিমেন্তো ইনস্টাগ্রামে পোস্টে বাবার মৃত্যুর বিষয়টি জানিয়ে তার আত্মার শান্তি কামনা করেছেন।দীর্ঘদিন কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন পেলে। এবারের কাতার বিশ্বকাপে তার দেশের খেলা দেখতে চেয়েছিলেন স্টেডিয়ামে বসে। কিন্তু চিকিৎসকের অনুমতি না পাওয়ায় পূরণ হয় না কালোমানিকের সেই ইচ্ছে।
ব্রাজিলের সর্বোচ্চ গোলদাতা, তিনবার বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলার, দ্য গ্রেটেস্ট অব অল টাইম, ব্ল্যাক ডায়মন্ড অব ফুটবল- অ্যাডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো পেলে। তাকে ভালোবেসে না জানি আরও কত নামেই ডাকতো তার ভক্তরা। ফুটবলে ব্রাজিলের রাজত্বের প্রথম রাজা তিনি।
পেলে মারা গেছেন তা যেন এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না ব্রাজিলের মানুষের। সবার বিশ্বাস ছিল লড়াই করে আবার নিজ বাড়ি ফিরবেন তিনি। তবে এবার আর ফেরা হলো না তার। না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন পেলে। যার জন্য দেশটির সরকার তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে। এই সময়টাতে সকলে ছুটি কাটাতে না গিয়ে সবাই সাও পাওলোতে ফিরছেন পেলেকে শেষবারের মতো বিদায় জানাতে।
ফুটবল সম্রাট পেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই অ্যালবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালের সামনে ভিড় করেন সমর্থকরা। তার মৃত্যু যেন এখনও কেউ মেনে নিতেই পারছেন না। তাই দেশের এমন এক শোকাহত সময়ে কেউই দেশ ছেড়ে ছুটি কাটাতে বাইরে যাচ্ছেন না। বরং অন্য শহর থেকে সবাই ছুটছে সাও পালোর দিকে।এদিকে প্যারিস থেকে আসতে পারেন নেইমারও। জানা গেছে, ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনোসহ সারা বিশ্বের অসংখ্য গণ্যমান্য অতিথিরাও পেলের শেষযাত্রা আসবেন।
৮২ বছর বয়সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া এই মহাতারকাকে শায়িত করা হবে সান্তোস ফুটবল ক্লাবের স্টেডিয়াম ভিলায়। ক্লাবের পক্ষে এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সর্বসাধারণের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য ‘ফুটবলের রাজার’ মরদেহ ২৪ ঘণ্টা রাখা হবে স্টেডিয়ামের মাঝমাঠে। পরদিন তার মরদেহ নিয়ে ‘শেষযাত্রা’ হবে সান্তোসের রাস্তায়। কফিন বহন করে নিয়ে যাওয়া হবে কেলেস্তের সড়কে, যেখানে পেলের মা থাকেন।
সোমবার (২ জানুয়ারি) পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে পেলের কফিনবন্দি দেহ নিয়ে যাওয়া হবে সান্তোসের মেমোরিয়াল নেক্রোপোল ইকুমেনিকাতে। অনুরাগীরা সেখানেই শেষবারের মতো শ্রদ্ধা ও বিদায় জানাতে পারবেন এই কিংবদন্তিকে। এরপর পেলেকে মেমোরিয়া নেকরোপোল একিউমেনিকা নামের সমাধিস্থলে পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে সমাহিত করা হবে।